জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

বাবু রহমান :
‘স্বাধীন স্বাধীন দিকে দিকে জাগছে বাঙালিরা।
র”খবে তাদের কারা, আজ র”খবে তাদের কারা?
আকাশ বাতাস পথে প্রান্তরে জয়ধ্বনি শোনা যায়
শৃঙ্খল বেড়ি কে আর পরাবে ওদের কঠিন পায়।
জীর্ণ ধরার ভিত ধরে ওরা দেবেই দেবে যে নাড়া ।।’
ঊনিশ’শ একাত্তর সাল যুদ্ধের বছর। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার মাস এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু এ স্বাধীনতার পেছনে যেমন রয়েছে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস তেমনি রয়েছে সঙ্গীত সংস্কৃতির ইতিহাস। কাজেই স্বাধীনতার গানের মূল্যায়ন করতে হলে ফিরে যেতে হবে গণসঙ্গীতের ইতিহাসে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুর, খুলনা, সিলেট, বরিশালে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। আর পেছনে রয়েছে সংগ্রামী ব্যক্তিত্বের নিরলস সংগ্রাম। এ বিজয়ের গানের সঙ্গে হাজার বছরের ঐতিহ্য জড়িত। দেশী-বিদেশী শাসক ক্ষমতায় এসেছে-গেছে কিন্তু বাংলাকে কুক্ষিগত করে, জনগণকে অত্যাচার করে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি। সংগঠিত হয়েছে বিদ্রোহ। আর সেই বিদ্রোহের গান তৈরি হয়েছে শিল্পী-গীতিকার ও সুরকারদের যৌথ শিল্পকর্মে।
ঊনিশশ’ সাতচল্লিশের পর যখন আটচল্লিশে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত তখন গর্জে উঠলো শেখ লুৎফর রহমানের কণ্ঠ। গর্জে উঠলো বিভিন্ন গীতিকারের লেখা এসব গানে। সত্যেন সেনের বাণীতে ‘এ আগুন নেভাইব কেরে’ স্বাধীনতা ও ভাষার গান। আনিসুল হক চৌধুরীর (১৯১৯)Ñ ‘শুধু ঘুম পাড়ানী গান আর নয়’, ‘ওরে ভাইরে ভাই বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই’, আব্দুল করিমের লেখা ‘আল্লা ভাত দে কাপড় দে বাঁচতে দেরে তুই’, আল্লামা ইকবালের রচিত অনূদিত গানÑ ‘ওঠো দুনিয়ার যত গরিবকে জাগিয়ে দাও’ ইত্যাদি গান। ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক ভিত্তি গড়ে উঠেছে এসব গানে। আর বায়ান্নোর আন্দোলনে শহীদ হলো যারা, রক্ত দিতে হলো নিজের ভাষার জন্য, তখন তৈরি হলো আরো তেজোদ্দীপ্ত গান। আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর (১৯৩৪) লেখাÑ ‘রক্তে আমার আবার প্রলয় দোলা’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র”য়ারি’, গাজীউল হকেরÑ ‘একুশে ফেব্র”য়ারি, একুশে ফেব্র”য়ারি’ ইত্যাদি গান। ঐ সময়ে ঢাকায় কামর”ন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে ‘সুরবিতান’ (১৯৪৮-১৯৫৫) নামে একটি সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পরিচালনা পরিষদÑএ প্রধান শিক্ষিকা আনোয়ারা বাহার চৌধুরীর সহযোগিতা পারিবারিক ঐতিহ্যের বহিঃপ্রকাশ। পাশাপাশি ‘দি টিকাটুলী লাইব্রেরী’ ও ‘অগ্রদূত সঙ্গীত সংসদ’ নামে দু’টি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন অকাল প্রয়াত নাজিম সেলিম বুলবুল। বায়ান্ন ও তেপান্ন জুড়ে গণসঙ্গীত নিয়ে তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ‘অগ্রণী সংগীত সংসদ’Ñএর বৈঠকখানা ছিল সাত-হাটখোলা সড়কে। আর এরা অনুষ্ঠান করতেন তৎকালীন ব্রিটিশ কাউন্সিল, তোপখানার ইউসিস অডিটোরিয়াম ও মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় অডিটোরিয়ামে বিভিন্ন অনুষ্ঠান তো হতোই। পঞ্চান্নোর দিকে ‘বুলবুল ললিতকলা’ একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব প্রতিষ্ঠান ও কর্মকাণ্ডে যারা সহযোগিতা করতেন। ওস্তাদ ইয়াসিন খান (জ-১৯৩০), ওস্তাদ বানী খান (গুল মুহাম্মদ সাহেবের আর এক সন্তান), জনাব মোজাফফর শিকদার, ওস্তাদ কামর”জ্জামান মনি (১৯২৭), আবু বকর খান (অকালপ্রয়াত), অশোক ঘোষ (চিত্র পরিচালক), ওস্তাদ আজিজ খান, ইউনুস আলী, সোনা মিয়া, রাজা হোসেন খান, অর”ণ কুমার, সুনীল কুমার, মানিক সাহেব, ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদ খান (১৯২৮-১৯৯৯), শৈলেশ ভৌমিকসহ আরো অনেকে।
বায়ান্নোর বিখ্যাত দেশজ সুরের গণসঙ্গীতের ভার্সেটাইল জিনিয়াস আব্দুল লতিফের গানÑ
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাউড়্যা নিতে চায়।
ওরা কথায় কথায় শেকল পরায় আমার হাতে পায়।’
রাজনীতি ও ছাত্রনীতি দানা বেঁধে উঠলো। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নূর”ল আমীনের রক্ত চাই; ‘ফ্যাসিস্ট সরকার গদি ছাড়’, ‘কালা কানুন বাতিল কর’, ‘নির্বাচনের ব্যবস্থা কর’, তেজোদ্দীপ্ত স্লোগানে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠলো। স্বাধীনতার বীজ এভাবেই তখন রোপিত হলো। তৈরি হলো আব্দুল লতিফের আরো একটি গানÑ ‘মাগো আটই ফাল্গুনের কথা মোরা ভুলি নাই।’
১৭৫৭ সালের পরাজয়, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পথ ধরে সিরাজউদ্দৌলা, শহীদ তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রীতিলতা আন্দোলনের পথ তৈরি করেছিলেন। সেই পথের সফল সঙ্গীত পীতাম্বর দাস রচিত ও তারা ভট্টাচার্য (জ-১৯০৯) গীত ঐতিহাসিক গানÑ
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
হাসি হাসি পরবো ফাঁসি
দেখবে জগদ্বাসী ।।’
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ নামে যে গণসংস্কৃতির সংগঠন গড়ে উঠেছিল তাদের বিখ্যাত বাংলা গানগুলো এখানেও গাওয়া হতো। নির্বাচন হবে চুয়ান্নতে। তাই সারা বাংলাদেশে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠলো। তখনকার গানে যে তীব্রতা, বলিষ্ঠতা ও ওজস্বিতা তা বাণীতে ফুটে উঠেছেÑ
‘ও দুনিয়ার মজদুর ভাইসব
আয় এক মিছিলে দাঁড়া।
ঐ নয়া জমানার ডাক এসেছে
এক সাথে দে সাড়া।’
ক্রমান্বয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজর”ল, দ্বিজেন্দ্রলাল ও রজনীকান্তের গানগুলো গাওয়া হতো। সেসব আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। বিশেষ করে আন্দোলনকে ভিত্তি করে যে গানগুলো রচিত সুরারোপিত ও পরিবেশিত হয়েছেÑ সেগুলোই আলোচনায় প্রাধান্য পাবে।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতি সংগ্রামের সম্মিলিত প্রয়াসে নির্বাচনে (১৯৫৪) যুক্তফ্রন্ট জিতলো। কিন্তু বাঙালির এ বিজয় পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারলো না। ভারত থেকে আসা সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ মানসিকতার লোক এসে আশ্রয় নিলে সম্প্রীতির মাটিতে বিষবাষ্প প্রোথিত হলো তাদের দ্বারা। আর সব ওলট-পালট করে ১৯৫৮-তে আইয়ুব খান সামরিক শাসন দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রের বীজ রোপিত করলেন। ধর-পাকড় ও অত্যাচার বেড়ে যাওয়ায় গণসঙ্গীতের টেম্পোটা কমে গিয়ে এক সময় নিছক দেশের গানে পর্যবসিত হলো বাংলা। আর এর পূর্ব অর্থাৎ ১৯৫৬-৫৭ সালগুলোতে ওপারের ফেরদৌসী রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, আব্দুল আলীম (১৯৩১-১৯৭৪) এবং এপারের মমতাজ আলী খান, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, কাজল রশীদ, ফজলে রাব্বি, নীনা হামিদ (জ-১৯৪৯), আব্দুল লতিফ, শেখ লুৎফর রহমান (১৯২০-১৯৯৪), বালুচর, আব্দুল হাকীমসহ আরো অনেকে গানে গানে সো”চার হলেনÑ তবে এদের রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকায় পরবর্তীকালে শেখ লুৎফর রহমান, আব্দুল লতিফ ও আব্দুল হাকীম ছাড়া বাকি সবাই প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তবে শেখ লুৎফর রহমানের সুরারোপিত সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দুর্মর’ কবিতা গণসঙ্গীতের নব সংযোজন হিসেবে আবির্ভূত হলোÑ
‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উ”ছ¡াসে
সে কোলাহলে র”দ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জল ও মাটিতে ভাঙ্গনের বেগ আসে।’
অন্যদিকে কোলকাতায় সলিল চৌধুরীর সুরে ও হেমন্তের কণ্ঠে সুকান্তর কবিতা ‘রানার’ রেকর্ড হলো। ঠিক ওই সময়ে নাজিম সেলিম বুলবুলের নেতৃত্বে সুরবিতান (২৭ নং মগবাজার রোড) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক ‘ননসেন্স ক্লাব’ গড়ে ওঠে। তাতে প্রগতিশীল কর্মকাণ্ড ও সঙ্গীত সংস্কৃতির চর্চা হতো। আর পাশাপাশি চললো ‘কাকরাইল কালচারাল এসোসিয়েশন’Ñএর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। গানের সংখ্যা তেমন না থাকায় কলকাতা গণনাট্য সংঘের (আইপিটিএ) বেশ কিছু গান এদেশে পাচার হয়ে এলো। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম গানগুলোÑ
১. ‘আরে, নাকের বদলে নর”ন পেলাম
টাক ডুমাডুম ডুম,
জান দিয়ে জানোয়ার পেলাম
লাগলো দেশে ধুম।’
২. ‘বিচারপতি তোমায় বিচার করবে যারা
আজ-জেগেছে এই জনতা।
তোমার ফাঁসির, তোমার কারাগারের পেষণ
র”খবে যারা আজ জেগেছে এই জনতা’
পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান যারা গাইতেন তাদের মধ্যে ড. সন্জিদা খাতুন (জ-১৯৩৩), বিলকিস নাসির”দ্দীন, আব্দুর রহিম, জাহেদুর রহিম (জ-১৯৩৫-১৯৭৮), আতিকুল ইসলাম (১৯৩৬-১৯৭৫), ফজলে নিজামী এবং আরো অনেক অন্যতম। এদিকে অত্যাচার ও অনাচার বেড়েই চলেছে। ইস্কান্দার মীর্জা আইয়ুব খানের বন্দুকের নলের মুখে পালিয়ে বাঁচলেন। সামরিক শাসনের ঘৃণ্য মহড়া এভাবেই শুর” হয়েছিল আমাদের দেশে।
১৯৬২’র শিক্ষা আন্দোলন। ১৯৬৪-র রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিণতি আওয়ামী লীগের ছ’দফা। ১৯৫৭ তে ভাসানীর ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম’, ১৯৫৪-র দেবেন শিকদারদের বাংলাদেশের ঘোষণা এবং করাচিতে লেঃ কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের গোপন সামরিক প্রস্তুতি সবই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বিজয়ের ভিত্তিভূমি। ১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের (১৯২০-১৯৭৫) বির”দ্ধে ‘শেখ মুজিব ও অন্যান্য মামলা’ নামে একটি মামলা দাঁড় করালো পাকিস্তানিরা। আর এদিকে ১৯৬৫-এর পাক ভারত যুদ্ধের সময় বেশ কিছু নির্মল দেশ গান তৈরি হলো। যাতে সাধারণ মানুষের কথা তেমন একটা আসেনি। আব্দুল লতিফের সুরে ও ওস্তাদ মীর কাশেম খানের সুরেÑ
১. ‘মাটি তুমি মায়ের মতো আমায় লালন করো।
আমার ক্ষুধার সুধা দিয়ে আমায় পালন করো ।।’
২. কবি আজিজুর রহমানের লেখাÑ
‘পলাশ ডাকা কোকিল ডাকা আমার এদেশ ভাইরে।
ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলানো এমন কোথাও নাইরে ।।’
তবে কবি ফরর”খ আহমদের ভাষা অন্যরকম। শব্দ চয়নে ‘ঝাণ্ডা’র ব্যবহারে তার মানসিকতা বোঝা যায়।
‘কুয়াশা কাটিয়ে উদয়ের আলো
ভোরের আকাশে জ্বললো।
ঝাণ্ডা উড়ায়ে অভিযাত্রীরা
দূর যাত্রায় চললো।’
এসব গানের স্রষ্টারা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এবং এদের কেউ রাজনীতি সচেতন ছিলেন না বা তাদের কোনো কমিটমেন্ট ছিল না। তবুও বলতে হয় ভালো কিছু গান তৈরি হলো।
১৯৬৯ সালে শেখ মুজিব জেলে আর তাঁর রাজনৈতিক গুর” ভাসানী বাইরে। প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে উঠলো দেশে। সকল ছাত্র সংগঠন মিলে তৈরি হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বার”দের মতো জ্বলে উঠলো সারা দেশ। ওদিকে ভিয়েতনামে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা খাঁমচে ধরলো। তৈরি হলো অনেক গান। মতলুব আলী লিখলেনÑ
‘দুর্গম লক্ষ্যের দুর্জয় শপথের
দুর্বার সে এক নামÑ ভিয়েতনাম।
ভিয়েতনাম (লাল সালাম) ।।’
আমাদের শিল্পীদের সঙ্গীত বাংলা ছাড়িয়ে বিশ্ব অঙ্গনের বিষয়বস্তু একীকরণ করলো বাংলা গানের সঙ্গে। সুরটি ছিল শেখ লুৎফর রহমানের। ৩০৩ জনকে আসামি করে ঐ মামলাটিকে জনৈক মেজর হার”ন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ কথাটি জুড়ে দেয়ায় আন্দোলন ফুঁসে উঠলো। বাফা, ছায়ানট, সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়, জাগো ললিতকলা কেন্দ্র তথা সঙ্গীত সংস্কৃতির বিকাশ সাধনে অগ্রণী ভূমিকা রাখলো এ আন্দোলন। সুরের এ ফুলকি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া ও বরিশালে ছড়িয়ে পড়লো। অনেক আগেই ঢাকায় চলে এসেছিলেন বরিশালের আলতাফ মাহমুদ। তার সুরারোপিত অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র”য়ারি।’
খুলনায় গড়ে উঠলো। সন্দ্বীপন। নেতৃত্বে হাসান আজিজুল হক, নাজিম মাহমুদ (জ-১৯৩৫-১৯৯৮), কে.বি. মাহমুদ (সাপ্তাহিক ওয়েভ পত্রিকার সম্পাদক), অধ্যাপক শহীদ খালেদ রশীদ, অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক প্রমথ বাবু, কবি আবু বকর সিদ্দিক (জ-১৯৪৩), অধ্যাপিকা জাহানারা বেগম প্রমুখ। আর সঙ্গীত বিভাগের সার্বিক কর্মকাণ্ডের নায়ক সুরকার সাধন সরকার (১৯২৮-১৯৯৩)।
এদের পরিচালনায় শতাধিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। ১৯৬৮ সালে কার্জন হলে ‘আফ্রো-এশীয় লেখক সংঘ’Ñ এর উদ্যোগে তিনদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সন্দ্বীপন ঢাকার এই অনুষ্ঠানে দেড় ঘণ্টার গীতিনাট্য ‘অপরাজেয়’ ভিয়েতনাম চল্লিশ জন শিল্পী নিয়ে পরিবেশন করলো। সে সব গানের মধ্যেÑ
১. ‘দেয়ালে দেয়ালে লটকে দাও একটি নামÑভিয়েতনাম।
মুক্তিপাগল রক্তøাত ভিয়েতনাম।
দেয়ালে দেয়ালে লাল হরফে যাও বলে
শঙ্কা মৃত্যু ঝঞ্ঝাকে আজ দাও বলে
জনসমুদ্র দুর্নিবার
কী উদ্দাম’ ভিয়েতনাম ।।’
২. ‘ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল
পাকে পাকে তড়পায় সমকাল।
মারী ভয় সংশয় ত্রাসে
অতিকায় অজগর গ্রাসে
মানুষের কলিজা, ছিঁড়ে খোড় খাবলায়
খাবলায় নরপাল ।।’
আবু বকর সিদ্দিকের কথায় সাধন সরকারের সুর ও নাজিম সেলিম বুলবুলের পরিচালনায় প্রচুর গণসঙ্গীত পরিবেশিত হয়েছে। এছাড়া ‘রক্ত তিলক ললাটÑ সূর্য রাজপথ রোশনাই (নাজিম-সাধন), আমরা চলেছি বিরাট কালে বিপুল তেপান্তর (নাজিম-সাধন), গায়ে মানে না আপনি মোড়ল (নাজিম-সাধন), আকাশের সে কপোত (নাজিম-সাধন), ধ্বংসের পরওয়ানা শোনো কি (নাজিম-সাধন), একুশের সীমাহীন পিপাসা (মনোয়ারÑ সাধন), একুশে নিয়েছি শপথ ভাই (আবু বকর সিদ্দিকÑ সাধন), নিষ্ফল কভু হয় না ধরা রক্তের প্রতিদান (নাজিম-সাধন), শান্তি না সংগ্রাম (নাজিম-সাধন), ‘সন্দ্বীপন’-এর গানগুলো খুলনা ছেড়ে দেশের রাজপথ গরম করে তুললো। ফলে শেখ মুজিবের মুক্তি লাভ। ১৯৬৯ ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ। এ আন্দোলন সত্তরের নির্বাচনের দিকে ধাবিত। এ সময় নজর”ল-রবীন্দ্রনাথ ছিল যে কোনো মঞ্চে অবধারিত সঙ্গীত। সিলেট থেকে কবি দিলওয়ার লিখেছিলেনÑ
‘আয়রে-চাষী, মজুর-কুলি, মেথর-কুমার-কামার
বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছেÑ বাংলা তোমার আমার।’
‘তোমাদের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ আমাদের নিয়ে এল সেখানে
উজ্জ্বল এক ঝাঁক আলোর পাখিরা ঐ পাখনা মেলেছে যেখানে’ রচনা ও সুুরÑ অজ্ঞাত।
শেখ লুৎফর সুর করলেনÑ সুকান্তের বাণীতেÑ
১. ‘হে মহামানব একবার এসো ফিরে
শুধু একবার চোখ মেল এই গ্রাম নগরের ভিড়ে ।।’
২. ‘বেজে উঠলো কী সময়ের ঘড়ি।’
৩. ‘এই হেমন্তে, এই নবান্নে, কাটা হবে ধান।’
ফলাফল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়। কিন্তু বাদ সাধলো ক্ষমতা বদলের পর্বে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। চললো ষড়যন্ত্র। জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকার (১ মার্চ ১৯৭১) নামে ও আলোচনার প্রহসনে বাঙালিদের মারার জন্য অস্ত্র আমদানি হলো। ৭ মার্চ বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বলিষ্ঠ ঘোষণা দিকনির্দেশনা দিলো। অসহযোগ চললো সারা বাংলায়। সত্যেন সেনের গড়া ‘উদীচী’, আলতাফ মাহমুদের ‘ক্রান্তি’ অগ্রণী ভূমিকা নিলো সঙ্গীত সংস্কৃতি সংগ্রামে। গড়ে উঠলো দিকে দিকে সম্মুখ সমর। বাঁশের কাঁধ সমান লাঠিই ছিল বাঙালির দুঃসাহসিক বিকল্প; যা পরবর্তীতে রাইফেলে রূপান্তরিত হলো। ঢাকার রাজপথে একাত্তরের ফেব্র”য়ারিতেই শিল্পীরা মহড়া দিয়ে রেখেছিল নতুন করে। ২৫ মার্চ চললো রাতের আঁধারে আক্রমণ। অরূপ রতন চৌধুরী, সাবিনা ইয়াসমিন, জাহেদুর রহিম, আব্দুল লতিফ, খন্দকার ফার”ক আহমেদ, রবীন্দ্রনাথ রায়, মাহমুদুন্নবী, শাহনাজ রহমতউল্লাহ গেয়ে বেড়ালেন দেশ গান।
শুর” হলো যুদ্ধ। শেখ মুজিবকে নিয়ে করাচি থেকে হাফিজুর রহমানের গানÑ ‘আমার নেতা শেখ মুজিব, দেশের নেতা শেখ মুজিব’ প্রকাশিত হলো গ্রামোফোন রেকর্ডে। আনোয়ার পারভেজের সুরে ও গাজী মাজহার”ল আনোয়ারের কথায় তৈরি হলো অমর গান।
‘জয় বাংলা বাংলার জয়
হবে হবে হবে হবে নিশ্চয়।
কোটি প্রাণ একসাথে মিলেছে অন্ধরাতে
নতুন সূর্যোদয়ের এই তো সময় ।।’
১৯৭১-এর সশস্ত্র সংগ্রামে চট্টগ্রামের বেতারের শব্দ সৈনিক অদম্য সাহসী কয়েকজন যুবক বেলাল মোহাম্মদ, মোস্তফা আনওয়ার, আব্দুল্লাহ আল ফার”ক, আবুল কাসেম সন্দ্বীপ, আব্দুস শুকুর, সৈয়দ আব্দুস শাকের, রাশেদুল হোসেন, আমিনুর রহমান, এ.এম. শরফুজ্জামান, রেজাউল করিম চৌধুরী, কাজী মাহবুব উদ্দীন, মোহাম্মদ হোসেন ও ফার”ক একটি ট্রান্সমিটার নিয়ে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের সূচনা করলেন। আর হানাদার বেতার কেন্দ্র থেকে ত্রিরতœ সাহসী বেতার কর্মী টি.এইচ. শিকদার, আশফাকুর রহমান ও তাহের সুলতান পালিয়ে গেলেন মুজিবনগরে। বালিশে করে কিছু টেপ। আরো পরে এসে যোগ দিলেন শব্দ সৈনিক শহীদুল ইসলাম, আশরাফুল আলম, আলী রেজা চৌধুরী, মনজুর কাদের, জামাল চৌধুরী, ্ এ.কে. শামসুদ্দীন, এস.এস. সাজ্জাদ প্রমুখ। তাঁদের প্রচারিত অনুষ্ঠান (ক) গণসঙ্গীত ও সমর সঙ্গীত, (খ) চরমপত্র, (গ) সংবাদ ও সংবাদ সমীক্ষা, (ঘ) কবিতা, পুঁথিপাঠ, গল্প ও কথিকা, (ঙ) যন্ত্র সঙ্গীত ও জাতীয় সঙ্গীত, (চ) বজ্রকণ্ঠ ও (ছ) জল্লাদের দরবার। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পাকিস্তানি সৈন্যদের ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে বাঁচতে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নিলো। শিল্পীরাও বসে নেই। পরিবেশিত গানের শিল্পী আব্দুল জব্বার (জ-১৯৩৮), কল্যাণী ঘোষ, স্বপ্না রায়, আপেল মাহমুদ, নমিতা ঘোষ, রথীন্দ্রনাথ রায় (জ-১৯৪৯), লাকী আখন্দ (জ-১৯৫০), মাধুরী আচার্য, সরদার আলাউদ্দীন (১৯৪০-১৯৭২), নাসরীন আহমদ শীলু প্রমুখ।
বিশেষ করে সিকান্দার আবু জাফর রচিত ও শেখ লুৎফর রহমান সুররোপিত গানÑ ‘আমাদের সংগ্রাম চলবে, জনতার সংগ্রাম চলবে’ গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কয়েকটি গণসঙ্গীতের অন্যতম।
মুক্তিযোদ্ধারা থানা-ফাঁড়ি লুট করে যেসব অস্ত্র পেয়েছে এবং বিডিআর ও পুলিশ থেকে পালিয়ে আসা সিপাহি সমন্বয়ে চললো প্রতিরোধ বিজয়ের নেশায়। আকাশ বাণী কলকাতা থেকে বাজতোÑ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গাওয়া অসাধারণ মেলোডি দেশ গানÑ
১. ‘মাটিতে জন্ম নিলাম মাটি তাই রক্তে মিশেছে
এ মাটির গান গেয়ে ভাই জীবন কেটেছে ।।’
এছাড়া মোহিনী চৌধুরীরÑ ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে কতো প্রাণ হলো বলিদান’ বিখ্যাত। যেমন সুর তেমন গায়কী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’, আর ডি. এল রায়ের ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা’ গান যুগপৎভাবে বিদ্রোহ ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতো মুক্তিযোদ্ধাদের। আর নজর”লেরÑ কারার ঐ লৌহ কপাট, এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল, ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি গানগুলো তো বাজতোই।
আব্দুল জব্বারের গাওয়াÑ ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, আপেল মাহমুদেরÑ ‘একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, রথীন্দ্রনাথের গাওয়াÑ ‘ছোটদের বড়দের সকলেরÑ আমার এই দেশ সব মানুষের’, সরদার আলাউদ্দীনের ‘হেই ডান বাঁম (৩) আয় বাঙালি মুক্তিসেনা বাংলার মান বাঁচাইরে’, হরলাল রায়ের ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’, স্বপ্না রায়ের ‘হায় কৃষাণ তোদের এই জীর্ণ দেহ দেখে যে রে অশ্র” মানে না’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, সমর দাসের সুরেÑ ‘ভেবনা গো মা তোমার ছেলেরা হারিয়ে গিয়েছে পথে’, মোশাদ আলীর ‘ওরে শোন বাঙালি ভাই’, মোঃ শাহ বাঙালির বেশ কিছু গান ও পুঁথিসহ অনেক কোরাস গানই বেশি বাজানো হতো। আর অরূপ রতন চৌধুরীর গাওয়াÑ ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী’ জনপ্রিয়তার চূড়ান্তে উঠেছিল। তাছাড়া আব্দুল লতিফের ‘সোনা সোনা সোনাÑ লোকে বলে সোনা’ এবং ‘মানবো না বন্ধনে মানবো না এই শৃঙ্খলে’, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘যায় যদি যাক প্রাণ’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁধ ভেঙে দাও’, অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। তারপরÑ
‘বাংলার কমরেড বন্ধু
এইবার তুলে নাও হাতিয়ার
ভূমিহীন কৃষক আয় মজদুর
গণযুদ্ধের ডাক এসেছে।’
গানে গণমানুষের মুক্তির কথা উঠে এসেছিল। যেসব গানের আবেদন এখনো সমান, বিশেষ করে আব্দুল জব্বারের ১. মুজিব বাইয়া যাওরে, ২. সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম মুজিবুর, এবং পশ্চিমবঙ্গের শ্যামল মিত্রের গাওয়াÑ ‘বাংলার হিন্দু, বাংলা বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, আমরা সবাই বাঙালি’।
শ্যামল গুপ্তের লেখা আব্দুল জব্বারের কণ্ঠেÑ ‘হাজার বছর পরে আবার এসেছি ফিরে’, সমর দাসের সুরেÑ ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্তলাল’, অংশুমান রায়ের গাওয়া ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’ ইত্যাদি গান প্রায় প্রতিদিনই বাজতো। এ গানগুলোর কোনোটি আকাশবাণী কোলকাতায় ও কোনো কোনোগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বাজতো। এ গানের সুররস সকল মানুষের মনে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার বীজ রোপণ করেছিল। যুদ্ধে যুদ্ধে নয় মাস কেটে গেলো। ডিসেম্বরে ভারত জড়িয়ে পড়লো যুদ্ধে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী রণকৌশলের যৌথ ব্যুহ রচনা করলো। সম্ভবত দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ৩ ডিসেম্বর থেকে ছয় ও সাত ডিসেম্বর পর্যন্ত তুমুল যুদ্ধ চলে। যশোরে স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন ঘুরে গেলেন মুক্তাঞ্চলে চৌদ্দ ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে অনেক অঞ্চল স্বাধীন হলো। কদম কদম বাড়ায়ে সামনে নয় পিছু হটে পাকবাহিনী ঢাকার দিকে। বাংলার কৃষক শ্রমিক জনতা বিজয়ের মুখোমুখি। অনেক প্রাণ ফিরে এলেও কেউ কেউ এলো না। বিজয় এলো বাঙালির, জয় বাংলার জয় ঘরে ঘরে অনুরণিত হল। সবার মুখে মুখে স্বাধীনতার গান। বিজয়ের প্রাক্কালে তৈরি হলো নতুন গানÑ ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ, বাংলার ঘরে ঘরে।’ এর রচয়িতা শব্দসৈনিক প্রয়াত শহীদুল ইসলাম, আর সুরশ্রষ্টা- সুজেয় শ্যাম।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের ভেতর দিয়েই এই স্বাধীনতা। তার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে একাত্তরের নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ। এ যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ। উপরোক্ত সংগ্রামের দীর্ঘপথ পরিক্রমায় সৃষ্টি হয়েছে অজস্র গান। যে গান দিয়ে এ নিবন্ধের প্রারম্ভ, এ গান দিয়েই বিজয়। বাঙালির ঐতিহ্য হাজার বছরের। যতোদিন বাঙালি থাকবে, যতোদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততোদিন স্বাধীনতার গান বেঁচে থাকবে।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান