জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

মুহম্মদ সবুর
‘পোস্টার হয়ে সেঁটে আছো হৃদয়ে’- এমন উ”চারণ কাব্যি করে হয়তো হয় না। কিংবা কবি জীবনানন্দ দাশের কাছে ক্ষমা চেয়ে হয়তো বলেও না, ‘তোমার হৃদয় আজ পোস্টার।’ এ রকম বলা না হলেও বাংলা গদ্যে-পদ্যে পোস্টার আছে, তার সঙ্গে আছে তারই জ্ঞাতি ভাই-বেরাদর ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, লিফলেট; মোড়কের ভাষ্য। পোস্টারে পোস্টারে শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জ ছেয়েছে বাংলাদেশ জুড়ে বিগত নির্বাচনের সময়ে। বাহারি বৈচিত্র্য না থাকা সব পোস্টারের রঙ-ধরন একই। এমনটা অবশ্য আগে হতো না। বাহারি রঙের-ঢঙের-আকারের পোস্টারে পোস্টারে সয়লাব হয়ে যাওয়া দৃশ্য দেখে বোঝা যেতো, কোন পোস্টারের ধারক কোন জন। এবারের ব্যতিক্রমের এই ধারা পোস্টার শিল্পের ইতিহাসে অন্যতর সংযোজন অবশ্য। নির্বাচনের প্রার্থীদের স্বপক্ষে পোস্টার প্রচারণার ইতিহাস তো প্রাচীন। পম্পেই নগরীতেও এর নিদর্শন মিলেছে। ষাট, সত্তর দশকের তার”ণ্য পোস্টার, প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, ফেস্টুনকে দেখেছে খুব কাছ থেকেই। নির্মাতাও ছিল তারা অনেক সময় নিজেরাই। হাতে লেখা সে সব পোস্টারের ভাষা ছিল রাজনীতির কিংবা দাবি-দাওয়া, অধিকার আদায়ের। পোস্টারের নানা বৈচিত্র্য এই উপমহাদেশে যতো, উন্নত দেশে সে আধিক্য অবশ্য নেই। দেয়ালে দেয়ালে, কার্নিশে-কার্নিশে, যত্রতত্র পোস্টার সেঁটে দেবার প্রবণতা এদেশে সম্পূর্ণ কেটে যাবে বলা যাবে না। সে লক্ষণও নেই। প্রচার-প্রসারে পোস্টার এখনো বেশ বড়সড় গণমাধ্যম। ‘দেয়াল লিখুন পড়ুন’-এর মতো ‘পোস্টার পড়ুন’-এদেশেরই ভাষা। কানাডায় অর্ধযুগ অবস্থানকালে পোস্টার তেমন চোখে পড়েনি। তবে বিক্ষোভ, সভা-সমাবেশ-সেমিনারে, প্ল্যাকার্ড-ব্যানারই প্রচলিত। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে পোস্টার আর গুর”ত্ব বহন করে না। যেমনটা এদেশে, পোস্টার ছাপিয়ে বাণিজ্যিক প্রচারের পাশাপাশি আত্মপ্রচারের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। তেমনটা উন্নত দেশে সম্ভবত প্রয়োজন হয় না। সভ্যতার সমান আয়ু এই পোস্টার শিল্পের রয়েছে এক ঐতিহ্য। বিবর্তনে পোস্টার থেকে এসেছে হ্যান্ডবিল, লিফলেট, মোড়ক ইত্যাদি। বাণিজ্য বসতিতে পোস্টার তো অন্যতম অনুষঙ্গ।
সবসময় সো”চার যে মাধ্যমটি, তা এই পোস্টার। শিল্পের জাদুস্পর্শে, সূক্ষ্ম উদ্ভাবনে সময়ের সঙ্গে পাড়ি দিয়ে প্রতিদিন নতুন থেকে নতুনতর হয়ে উঠছে এই মাধ্যমটি। বিবর্তনে পোস্টার হয়ে উঠেছে একাধারে সভ্যসমাজের হাতিয়ার, দর্পণ এবং অলঙ্কার। প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের ভাষা হয়ে পোস্টার গর্জে উঠেছিল এদেশে সেই একাত্তর সালে। শিল্পী কামর”ল হাসানের আঁকা বিখ্যাত সেই পোস্টার ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে, আসুন আমরা জানোয়ার হত্যা করি।’ একাত্তর সালের সে সব পোস্টার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে গাঁথা থাকবে। পোস্টারের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতা অবশ্যই প্রশ্নাতীত।
পৃথিবীর প্রাচীনতম পোস্টার কোনটি তার অবশ্য হদিস মেলেনি। সত্যি বলতে কি পোস্টারের জন্মরহস্য ভেদ করা হয়নি আজো। প্রাচীনযুগে রাজ-রাজড়ারা প্রচারকাজে ভেরীবাদক ও ঘোষকই ব্যবহার করেছেন। অনুশাসনও প্রচার করেছেন এভাবেই। আবার স্মৃতিসৌধ ও স্তম্ভ নির্মাণ করে ধর্মীয় অনুশাসন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কিংবা ছিল প্রস্তরলিপি। যাতে শাস্তি ও পুরস্কারের ঘোষণাও থাকতো। জর”রি সংবাদ, নির্দেশ ও নীতি প্রচার হতো এভাবে। কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যাপক জনগণের সঙ্গে সংযোগ সাধনে ছিল অপারগ। গুহাচিত্রের সঙ্গে পোস্টারের আত্মীয়তাও আবিষ্কার করা হয়েছিল একসময়।
পণ্য প্রচারে প্রাচীনকালে
পোস্টারের জন্ম ইতিহাস তেমন পাওয়া না গেলেও এই শিল্পের আদিপিতা হিসেবে স্বীকার করা হয় ইতালীয় এমিলিয়া সেলারকে। পম্পেই এবং হার্কুলানিয়ামে প্রতœতাত্ত্বিক খননকাজ তুলে এনেছে পোস্টারের এক সম্পন্ন ঐতিহ্য। যার অধিকাংশই বাণিজ্যিক পোস্টার। এর মধ্যে অবশ্য কিছু আছে রাজনীতি সম্পর্কিত নির্বাচনের প্রার্থীদের স্বপক্ষে সো”চার প্রচার। এছাড়াও প্রদর্শনী, সরাইখানার বিজ্ঞাপন, জমি ভাড়া এবং বিক্রির সংবাদ জ্ঞাপক-নোটিশ জাতীয় পোস্টারের সংখ্যা যথেষ্ট। এই সময়ে বিজ্ঞাপন কাজে পোস্টারের এই ব্যবহার স্পষ্ট করে; আরো আগে থেকেই এর প্রচলন ছিল। পম্পেই নগরীতে জনসমাগমের স্থান ছিল পোস্টারের জন্য নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট দেয়ালে লাল এবং কালো দু’রঙেই পোস্টার লেখা হতো। পোস্টারে রঙের ব্যবহার প্রাচীন রোম সভ্যতায়ও ছিল। গণস্নানাগারে হারানো-প্রাপ্তি-নির”দ্দেশ জাতীয় পোস্টারও আছে। হারানো বস্তুর জন্য উদ্ধারকারীকে পুরস্কার দেয়া হবে মর্মে পোস্টারও সাঁটা হতো। আগ্নেয়গ্রাসের বলিশহর পম্পেই নগরীর একটি বাড়ির দেয়াল পোস্টারের জন্য এতো ঘনভাবে ব্যবহৃত হয়েছে যে, ধারণা করা হয়, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের জন্য যেমন ভাড়া নিতে হয়, পোস্টারের জন্যও সম্ভবত নিতে হতো। পম্পেই নগরীর এই পোস্টার শিল্পের বিকাশে প্রধান ব্যক্তি ছিলেন এমিলিয়াস সেলার। দুজন সহকারী নিয়ে এই পোস্টার লেখার কাজ করতেন রাতের বেলায়। ‘চাঁদের আলোর সাহায্যে সম্পূর্ণরূপে এমিলিয়াস সেলার কর্তৃক লেখা পম্পেই নগর খনন করে এরকম ঘোষণা সমেত সেলারের একটি পোস্টার পাওয়া গেছে। যা ছিল গ্লাটিয়েটরের লড়াইয়ের ঘোষণা বিষয়ক। পোস্টারে নিজের ঠিকানাও লিখে দিতেন সেলার। যাতে বিজ্ঞাপনদাতারা যোগাযোগ করতে পারেন। বলা যায়, সেলারই পৃথিবীর প্রাচীনতম বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধার। কেবল পম্পেই এবং হার্কুলানিয়াম শহরেই আবিষ্কার হয়েছে ১ হাজার ৬শ নির্বাচনী পোস্টার। পম্পেইয়ের মতো প্রাদেশিক শহরেই পোস্টারের এতো আধিক্য, আর রোমের সুবিশাল ও সমৃদ্ধ নগরগুলো, কার্থেজ, আলেকজান্দ্রিয়ার মতো শহরের সুসজ্জিত পথেঘাটে পোস্টারের প্রবল জোয়ার ছিল নিশ্চয়। যদিও এর কোনো বর্ণনা সেভাবে মেলেনি। রোমের পতনের পর পোস্টার মাধ্যমেরও বুঝি পতন ঘটেছিল। কারণ নগর পতনের ফলে মানুষ গ্রামে ফিরে যায়; মূলত খামারের কাজে। যেখানে পোস্টারের নেই প্রয়োজন।
শিক্ষার প্রসার পোস্টার শিল্পকে আবার জনসমক্ষে ফিরিয়ে আনে। ব্যবসায়ী এবং কারিগররা তাদের দোকান তথা কর্মস্থলের কাছে কিছু প্রতীক বা চিহ্ন ঝুলিয়ে দিতে শুর” করে ষোড়শ শতকে। ঐ চিহ্ন বা প্রতীক স্পষ্ট করতো তাদের কাজের ধরন। যা মূলত দোকানের বিজ্ঞাপন। তালাচাবির কারিগরের দোকানের সামনে সেঁটে দেয়া হতো বিশাল একটি চাবির ছবি। দস্তানার কারিগরের দোকানের সামনে দস্তানার ছবি টাঙানো হতো। এই সব প্রাচীন চিহ্নসমূহের মধ্যে উল্লেখ করা যায়, হ্যানস হলবেনের আঁকা ১৫১৬ সালের একটি চিহ্ন। যার দুদিকে আঁকা। যাতে দুদিক থেকে আসা মানুষজনের চোখে পড়ে। এমন পোস্টার ঢাকায় অহরহ মেলে। হলবেনের পোস্টারের বিজ্ঞাপন ছিল একজন স্কুল শিক্ষার্থীর। যিনি শিশু-কিশোরদের লেখাপড়ার গ্যারান্টিসহ বয়স্কদের শিক্ষিত করার নিশ্চয়তাও দিয়েছেন। এখনকার একশভাগ উত্তীর্ণ বা নাম্বার পাবার গ্যারান্টির মতোই। হলবেনের আঁকা পোস্টারটি আজো বাসেলের জাদুঘরে সযতেœ রক্ষিত আছে। অবশ্য হলবেনের এই অংকনের সময়কালে মুদ্রণযন্ত্র অর্ধশতাব্দী পাড়ি দিয়েছে। শিল্প হিসেবে বিকশিত হ”েছ এনগ্রেভিং। শিক্ষা-দীক্ষা বাড়ছে। স্বাক্ষর জনসংখ্যার হারও বৃদ্ধির দিকে। ব্যবসায়ীরা মুদ্রিত পণ্য সরবরাহে ঝুঁকে পড়লেন। প্রকাশক ও মুদ্রকদের প্রচারিত বিজ্ঞাপনের বহর দেখে বোঝা যায়, এই ব্যবসাটি বেশ ব্যাপ্তি পেয়েছিল সে সময়। প্ল্যাকার্ডের সাহায্যেই এ ধরনের বিজ্ঞাপন চালানো হতো। পোস্টার-প্ল্যাকার্ডই ছিল তখন একমাত্র প্রচার মাধ্যম। এতে পণ্য, তার নির্মাতা ও ব্যবসায়ীর দক্ষতা সম্পর্কে লেখা থাকতো।
মুখ ঢেকে যায়
পোস্টারের জগতে প্রথম যে বিপ্লবটি ঘটে ছোটখাটো হলেও তা হ”েছ মুদ্রিত ছবি। ১৪৯১ সালে ভাষ্যের সঙ্গে শিল্পীর আঁকা ছবি পোস্টারে আবির্ভূত হলো। একটি গ্রন্থের প্রচারের জন্য প্রথম সচিত্র পোস্টার এটি। ‘দ্য লাভলি মেলুগিনা’ নামক আদিম যৌন আবেদন বিষয়ক গ্রন্থটির জন্য প্রকাশক বেছে নেন পোস্টার মাধ্যমটাকে। তবে কিছুটা সৃজনশীলভাবে। নায়িকার স্নানরত রূপটি স্থূল আঙ্গিকের উড-কাট পদ্ধতিতে পোস্টারে আনা হলো। এ ঘটনার পর ১৫১৮ সালে পোস্টারের ক্ষেত্রে আরেক বিবর্তন ঘটে। পোস্টারের স্রেফ কেজো ভূমিকার সঙ্গে যুক্ত হলো নান্দনিক সূক্ষ্মতা। বিজ্ঞাপনকে শিল্পের স্থানে নিয়ে যাওয়ার কুশলতা দেখা গেলো। লটারির এই পোস্টারটির শিল্পী অলরেখ্ট অল্টড্রোফার। মেকলেনবার্গের রোস্টকে এই লটারিটি অনুষ্ঠিত হয়। পোস্টারটির মাথায় শিল্পী এঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন লটারির খেলাটি যথেষ্ট ন্যায়সম্মতভাবেই অনুষ্ঠিত হবে। কোনো রকম জালিয়াতির আশঙ্কা নেই। নিচে লেখা ছিল পুরস্কারের বিবরণ, র”পোর পাত্র, ফারের কোট, দামি পোশাক ইত্যাদি। ক্রেতাদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রতিটি পুরস্কারের বাজারচলতি দামও লিখে দিয়েছিলেন শিল্পী। সেই ধারা এখনো প্রবাহিত। এই বাংলাদেশে লটারির পোস্টার সেই ধারারই যেন।
বিবর্তনের পথ ধরে
বিবর্তনে পোস্টার শিল্প হয়ে দাঁড়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গুর”ত্বপূর্ণ উপাদান। ভোগ্যপণ্য থেকে সার্কাস, কুকুরের খেলা ও প্রদর্শনীর টিকেট বিক্রির কাজও হতো এই পোস্টারের মাধ্যমেই এবং তা হয়ে গেলো ব্যবসায় গুর”ত্বপূর্ণ অঙ্গ। পোস্টারকে ভোগ্যপণ্য প্রচার ও বিক্রির হাতিয়ার এবং মাধ্যম হিসেবে সত্যিকার প্রতিষ্ঠা দিয়েছে ফরাসিরা। পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে পোস্টারকে প্রত্যক্ষ মাধ্যম সৃষ্টি করেছে ফরাসিরাই। প্রদর্শনী ও খেলায় দর্শকের আকৃষ্ট করার মাধ্যম পোস্টারের ব্যবহার তখন যথেষ্ট ব্যাপ্তি পেয়েছিল। ছাপাখানার কর্মীরা এসব মুদ্রিত পোস্টারের এনগ্রেভিংয়ের কাজ করতেন। এদের কাছে কল্পনাশক্তির সাক্ষ্য ছিল একটি বিরল ঘটনা। অবশ্য এদের কাজে পেশাদারিত্বের ছাপ ছিল না। অনেকটা ‘অ্যামেচার’ ধরনের কাজ।
একটি পোস্টারের হাজার হাজার কপি ছাপানোর কাজটি প্রথম করেন জাহাজের এক ডাচ ক্যাপ্টেন। বাংলাদেশ থেকে একটি গণ্ডার তিনি নিয়ে যান জাহাজে করে। ১৭৪৭ সালে গণ্ডারটি প্রদর্শনীর জন্য পোস্টারের মাধ্যমে প্রচার চালান। লাতিন, ফরাসি, জার্মান ও ইংরেজি-এই চারটি ভাষায় তিনি এক-ই পোস্টারের অজস্র কপি ছাপান। তার লক্ষ্য ছিল পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে গণ্ডারের প্রদর্শনী আয়োজন করে তাতে এই পোস্টারটিকে প্রচারের কাজে লাগানো।
প্রচার পতিত রাজ রোষে
প্রচারাভিযানে পোস্টারের জাদুকরী প্রভাব সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেশ তবিয়তের সঙ্গেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ রাজার নজর পড়ে গেলো পোস্টারের ওপর। ১৬৫৩ সালে রাজার অনুমতি ছাড়া পোস্টার ছাপানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো। কেবল গ্রন্থ প্রকাশক ও ব্যবসায়ীদের এর আওতার বাইরে রাখা হয়। ১৭৭২ সালে জারি করা আইনে সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে পোস্টার লাগানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। গ্রন্থ ব্যবসায়ীরাও এর আওতায় পড়ে যান। পোস্টারের ওপর রাজন্যশক্তির হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র আরো আগেই তৈরি হয়েছিল। কারণ এই মাধ্যমটি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে প্রভূত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ফলে রাষ্ট্রশক্তি তা নিয়ন্ত্রণে তৎপর হয়েছিল। একই সময়ে মুদ্রণশিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ বয়ঃসন্ধি ছাড়িয়ে যাওয়ায়, রাষ্ট্র প্রকাশনা ব্যবসাকেও নিয়ন্ত্রণে আনে। শুধু পোস্টার বা প্রকাশনার ওপর নিয়ন্ত্রণ জারি করে ক্ষান্ত হয়নি। জনগণের জন্য পোস্টার লাগানোর নির্দিষ্ট স্থানটিতে রাষ্ট্রীয় পোস্টার সাঁটানো শুর” হয়। সামরিক বাহিনীতে লোক নিয়োগের জন্য সরকার পোস্টার মাধ্যম ব্যবহার করে। এই পোস্টারে সেনাদের সুসজ্জিত ইউনিফর্মে শোভিত, মুখে গর্বিত হাসি দেখা যেতো। ফ্রান্স থেকে এ ধরনের পোস্টার ইউরোপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টারের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর অর্থ দাঁড়িয়ে গেলো: নিশ্চয়তা, সুনাম এবং আনন্দময় জীবন।
কল্পনারহিত প্রচার মাধ্যম
অষ্টাদশ শতকে যুক্তিবাদের তোড়ে পোস্টারকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা দেখা দেয়। বলা হলো, এটি কল্পনা রহিত স্থূল প্রচার মাধ্যম। যুক্তিবাদের ঢেউ গ্রন্থ ব্যবসার একাংশকে প্ররোচিত করেছিল পোস্টার ব্যবহার না করার জন্য। এই মতের পুরোধারা মনে করতেন পোস্টার একটি নিকৃষ্ট মানের শিল্প। কিন্তু এতে প্রকাশক-ব্যবসায়ীদের লাভ হয়নি। পোস্টার ছাড়া গ্রন্থের প্রচার, বিজ্ঞাপন তাদের ভাবনায় ছিল না। এ সময় পোস্টারের আকারে পরিবর্তন আসে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে আয়তনে সংক্ষিপ্ত হলো একটু। সেই সঙ্গে পোস্টারের ধারণা ও সংজ্ঞাতে এসেছে আবশ্যিক পরিবর্তন। পোস্টার যে কোনো আকারের হতে পারে বলে মত বেরিয়ে এলো। অর্থাৎ ছোট একটি ডাকটিকেট থেকে বিশাল আকারের হোর্ডিং পর্যন্ত। আইনের ঝুট-ঝামেলা এড়াতে ব্যবসায়ীরা ছাপাখানা এবং এনগ্রেভারদের ছোট আকারের পোস্টার ছাপানোর অর্ডার দেন। যা কোনো দেয়ালে সাঁটতে হবে না। হ্যান্ডবিলের মতো হাতে বিলি করা যাবে। এভাবেই জন্ম হলো হ্যান্ডবিলের। ফ্রান্সেই এই ক্ষুদ্রকায় পোস্টারের প্রথম প্রচলন হলেও ইংল্যান্ডের ব্যবসায়ীদের কাছে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হলো।
রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার ভেতর পোস্টার শিল্প পেলো ভিন্ন মাত্রা। আবির্ভূত হলেন সৃষ্টিশীল শিল্পী উইলিয়াম হগার্থ। ব্রিটেনের টেইলরিং ও জুয়েলারিসহ বহু ব্যবসায়ীর হয়ে তিনি প্রচুর ‘এনগ্রেভিং’য়ের কাজ করেছেন। একই সময়ে লন্ডনে ফার্নসেন্তো বার্তোলু”িচ নামে আরেক শিল্পী কাজ করতেন। ছাত্রদের নিয়ে সব ধরনের ব্যবসায়ীদের জন্যই তিনি পোস্টার তৈরি করতেন। এসব পোস্টারে অধিক অলংকরণ থাকতো। বার্তোলু”িচ থিয়েটার, কনর্সাট ইত্যাদির পোস্টার তৈরি ছাড়াও টিকেটও করে দিতেন। নানা চিত্তাকর্ষক ডিজাইন ‘এনগ্রেভ’ করে এইসব টিকেট তৈরি করতেন। এগুলো তাঁর কাছে ছিল পোস্টারের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ। নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসায়ীরা হ্যান্ডবিল বিতরণ শুর” করেন। এই সব হ্যান্ডবিল মিনি-পোস্টার মূলত। এসব হ্যান্ডবিলের প্রধান আকর্ষণ হলো অঙ্গসজ্জা ও শিল্পবোধ।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুর”তে পোস্টারের জগতে আরেক বিস্ফোরণ ঘটায় ফ্রান্স। একই সঙ্গে ব্যাপ্তির এবং শিল্পের। ভোগ্যপণ্যের ব্যবহার তখন বাড়ছে। সাবান, সিগারেট, সুগন্ধী এবং সাধারণের ব্যবহারযোগ্য নানা সামগ্রী ‘ব্র্যান্ড নেম’ সমেত বাজারে এসে গেছে। এই সব সামগ্রীর মোড়ক হিসেবে এলো পোস্টারের ধারণা ও অভিজ্ঞতা। চিত্র ও নমুনা নকশা সংবলিত পোস্টার মোড়কে রূপান্তরিত হলো। এটা আদতে ক্ষুদ্রতম পোস্টারের এক বিপুল সাফল্যের সাক্ষ্য যেন। কৌটার বাইরের দিকে কোম্পানির নাম, পণ্যের গুণাগুণ মুদ্রিত থাকার ধারাটি আজো প্রবহমান। এ সময়ে আবিষ্কৃত দুটি পদ্ধতি পোস্টারকে অভূতপূর্ব সাহায্য করেছে। লিথোগ্রাফিক প্রক্রিয়া এবং হাইস্পিড প্রেস।
শিল্প হয়ে ওঠার অবকাশ
যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ পোস্টারকে শিল্প হওয়ার অবকাশ দিয়েছে। লিথোগ্রাফির ব্যবহারে রঙের নানা খেলা চালু হলো পোস্টারে, ১৭৯৫ সালে আলোইস সেনেফেল্ডারের এই আবিষ্কারের ফলে মুদ্রণ প্রক্রিয়ার দিক থেকে লিথোগ্রাফি হয়ে উঠলো সব থেকে অবাধ। এনগ্রেভিং যুগ থেকে লিথোগ্রাফি যুগে প্রবেশের ঘটনা পোস্টারের প্রকৃত যৌবন অর্জন যেন। এমনিতেই এনগ্রেভিংয়ের কাজ পরিশ্রম সাধ্য। আলো আঁধার, গভীরতা ইত্যাদি যথার্থ ফুটিয়ে তোলার জন্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম লাইন টানা দরকার হতো। লিথোগ্রাফিতে রঙ একটি বাড়তি সুবিধা। দ্র”ত সংস্করণশীল ইঙ্গিতবাহী আঁচড়েই তা সম্ভব হয়। কারিগরি প্রভাবেই শিল্পের সিংহ দরোজা পেরিয়েছে পোস্টার।
বৈচিত্র্যময় ও বিপুল সংখ্যক পোস্টার ছাপার ক্ষেত্রে হাই¯িপড মেশিন যুগান্তকারী ঘটনা। এরপর আগে ফ্লাট-বেড মেশিন। সঙ্গে রিভলভিং সিলিন্ডার। এ দুয়ের যোগফলে মুদ্রণের যেসব সুবিধে তৈরি হলো, তার প্রথম ভোক্তা ছিল ‘দি লন্ডন টাইমস’ পত্রিকা। ১৮১৪ সালের ২৯ নভেম্বর এই নতুন মেশিনে ঘণ্টায় ১১০০ কপি ছাপা হয়। ঐ দিন ছাপা হয়েছিল ২,৯১,৮১৪টি কপি। পাঠক সমাজের হার বাড়ছিল, তার প্রমাণ এই মুদ্রণ সংখ্যা, এর ৩৪ বছর পর ১৮৪৮ সালে মেশিনের ¯úিড বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি ঘণ্টায় ১০ হাজার শিট। ১৮৬৫ সালে আসে ওয়েব মেশিন। এবার কাটা কাগজ নয়; কাগজের রোল থেকেই পত্রিকা ছাপা হতে থাকে।
পোস্টারের ভাষা হ”েছ শব্দ এবং ছবি। লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য প্রধানত একটি বক্তব্যকে দর্শক-পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। পোস্টারের এই গণসংযোগের দিকটি প্রধান হওয়ায় শিল্প মাধ্যম হিসেবে এর আসন দ্বিতীয় সারিতে। পোস্টারের শতবছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, চিত্রকলার প্রতি একটি গভীর টান রয়েছে। ফরাসি শিল্পী জুলেস চেরেট (১৮৩৬-১৯৩৩) এই প্রাচীন শিল্প মাধ্যমটিকে করে তোলেন সাতরঙা রঙধনু। ১৮৮৬ সালে জুলেস প্যারিসে নিজের প্রেস থেকে রঙিন লিথোগ্রাফিক পোস্টার ছাপাতে শুর” করেন। পোস্টারকে আঙ্গিক হিসেবে দেখা শুর” হয় ১৮৬৯ থেকে। লিথোগ্রাফিককে সরাসরি সৃজনশীল মাধ্যম হিসেবে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন জুলেস। তিনি সরাসরি লিথোগ্রাফিক স্টোনেই নকশা এঁকে দিতেন। ছাপাতেন সেনেফেল্ডার মেশিনে। এই সময়ে বিভিন্ন গ্রন্থে চিত্র এবং অলঙ্করণের প্রাধান্য দেখা যায়, এসব চিত্র বিজ্ঞাপন আকারে প্রচার করা হতো। অবশ্য জুলেসের পোস্টার বিজ্ঞাপনই প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে পোস্টারকে মহিমান্বিত করে। ডিজাইনের সহজ প্যাটার্ন প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তীকালে এই সহজতাই পোস্টারের টেকনিকের অন্তর্ভুক্ত অন্তর্বস্তু হিসেবে গ্রাহ্য হয়। জুলেস অবশ্য বলেছিলেন, পোস্টার বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসেবে এমন চমৎকার কিছু নয়। তৃতীয় নেপোলিয়ানের সময় প্যারিসের রাস্তার দেওয়ালগুলোতে নান্দনিকতার চিহ্ন রেখেছেন জুলেস। এ সময় পোস্টার ভূমিকা নেয় ম্যুরালের। রাস্তার আর্ট গ্যালারি হিসেবে মর্যাদা পেলো পোস্টার। ফ্রান্সে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ব্রিটেনে তা ছিল না। ফলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পোস্টারে পোস্টারে সছয়লাব হয়ে যায় ব্রিটেন। পোস্টারের আতিসয্যে নাগরিকরা উত্ত্যক্ত হয়ে প্রতিবাদ জানায়। যত্রতত্র পোস্টারিঙের কারণ; কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানও ক্ষোভের কারণ হয়। ১৮৬১ সালে সাময়িক মহামারী অতিক্রম করে সুচার”রূপ নিয়ে পোস্টারের আবার আত্মপ্রকাশ ঘটে। একটি গ্রন্থের বিজ্ঞাপন ছিল পোস্টারটি। এক রঙা, উডকাটের পোস্টারটি। যাতে ছিল স্তব্ধতার চিত্ররূপ।
চিত্রিত কথামালা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভোগ্যপণ্যের বিজ্ঞাপনের পোস্টারের স্থানে দেখা যায় যুদ্ধের ওপর প্রামাণ্য চিত্র নিয়ে পোস্টার। এগুলোকে রাজনৈতিক পোস্টার বলা যায়। সরাসরি রাজনীতির পোস্টার বলা যায় রাশিয়ার ১৯১৯ সালের পোস্টারকে। ব্যাঙ্গাত্মক ধাঁচের এসব পোস্টার কমিক সিট্্রপের সিনেমাটিক দৃশ্যের মতো আঁকা। এসব পোস্টার আঁকায় কবি মায়াকোভস্কির যথেষ্ট অবদান ছিল। আমেরিকা, কানাডায় পোস্টারের তেমন ঐতিহ্য নেই। আমেরিকার প্রথমদিকের পোস্টার নির্মাতারা ছিলেন মূলত চেক ও জার্মান এনগ্রেভররা। বিজ্ঞাপনদাতার বক্তব্য পৌঁছানো ছিল এসব পোস্টারের লক্ষ্য। উনিশ শতকের শেষে প্রকাশনা ব্যবসায় সাফল্যই মার্কিন পোস্টার শিল্পে প্রথম রক্তসঞ্চার ঘটায়। সংবাদপত্র, সাময়িকীগুলো ভূমিকা নেয়। সাময়িকীর প্র”ছদ আঁকার জন্য পোস্টার শিল্পীদের নিযুক্ত করা হয়। পত্রিকার প্র”ছদই বৃহৎ আকারে ছেপে পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পত্রিকাস্টলে বা স্ট্যান্ডে এ ধরনের পোস্টার ব্যবহার পাঠকের উৎসাহ ও আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে এবং সে সঙ্গে বিক্রিও। ১৮৯৫ সালে বিশ্বের প্রথম শিল্প প্রতিযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রেই হয়। ‘সেঞ্চুরি’ পত্রিকা কভার ডিজাইনের জন্য নিয়মিত প্রতিযোগিতার আয়োজন করতো। বাছাই করা চিত্র প্র”ছদ ও পোস্টার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জার্মানি, চীন, রাশিয়ায়ও পোস্টারের ক্ষেত্রে নানা বিবর্তন ঘটেছে। সে সব স্থানে পোস্টারের রাজনীতিক আধিক্য ছিল বেশি। বিভিন্ন শিল্প আন্দোলন প্রচারমুখী হয়েছে এই পোস্টারের মাধ্যমেই। এই প্রচারের মধ্যে নিহিত প্রতিবাদ পোস্টারকেও জুগিয়ে দিয়েছে এক গুর”ত্বপূর্ণ ভাষা।
স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় যে সব পোস্টার মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায় আঁকা হয়েছিল, তা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত হয়েছে। পাবলো পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ ম্যুরালটিতে পোস্টারের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বলে অনেক শিল্পামোদী মনে করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী ‘আর যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ পোস্টার বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল।
বাংলাদেশের স্বাধিকার, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে পোস্টার এক গুর”ত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। পোস্টার যে যথেষ্ট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রচার মাধ্যমÑতা এ দেশে এই একুশ শতকেও প্রমাণিত দিনবদলের সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। পোস্টার আছে, থাকবে, মানুষের জীবনযাপনের প্রতি প্রয়োজনেই যেন। পোস্টারের ইতিহাস সেভাবে আলোচিত না হলেও শিল্পের ইতিহাসে এটি এক অনন্য মাধ্যম; অনায়াসে বলা যায়।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান