জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

মৃণ্ময়ীর দুর্দানত্ম স্বভাবের পরিচয় পাই রাখালদের বাড়িতে অপূর্বর কনে দেখার মুহূর্তে৷ কনেটি অপূর্বর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, এমনি সময় বাসার বাইরে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল৷ মুহূর্তের মধ্যে দৌড়িয়ে, হাঁপিয়ে পিঠের চুল দুলিয়ে মৃণ্ময়ী ঘরে এসে প্রবেশ করলো৷ ঘরে প্রবেশ করে কনের ভাই রাখালের হাত ধরে টানাটানি শুরম্ন করে দিল৷ রাখাল উঠতে না চাওয়াতে মৃণ্ময়ী তার পিঠে একটা সশব্দ চপেটাঘাত করে কনের মাথার ঘোমটা খুলে দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল৷ যাওয়ার সময় দ্বারের কাছে রাখা বরের নতুন জুতো জোড়াটি সে নিয়ে গেল৷

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাস পশ্চিমের দান৷ আর উপন্যাসের মতো ছোটগল্পের জন্মও পশ্চিমে_ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইউরোপ হয়ে ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যে এসেছে৷ রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের সফল রূপকার৷ রবীন্দ্রনাথ ৬ নভেম্বর ১৮৯০ সালে বিলেত থেকে ফিরে জমিদারির কার্যভার গ্রহণ করে রাজশাহী জেলার পতিসরে যাত্রা করেন৷ উত্তরবঙ্গে বাস করতে এসে তিনি হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ ভরা মানুষকে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন৷ তার কথায়, ‘এক সময় ঘুরে বেড়িয়েছি বাংলার নদীতে নদীতে, দেখেছি বাংলার পলস্নীর বিচিত্র জীবনযাত্রা৷ একটি মেয়ে নৌকা করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল, তার বন্ধুরা ঘাটে নাইতে নাইতে বলাবলি করতে লাগলো, আহা যে পাগলাটে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ওর না জানি কি দশা হবে৷ কিংবা ধরো একটা খ্যাপাটে ছেলে সারা গ্রাম দুষ্টুমির চোটে মাতিয়ে বেড়ায়, তাকে হঠাত্‍ একদিন চলে যেতে হলো শহরে তার মামার কাছে৷ এটুকু চোখে দেখেছি, বাকিটা নিয়েছি কল্পনা করে৷’ (রবীন্দ্র রচনাবলী পৃষ্ঠা ৫৩৮-৩৯)৷ এভাবেই তার ছোটগল্পের সৃষ্টি৷ রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো মূলত ভাবঘন৷ পলস্নীজীবনের নানান ঘটনা থেকে এ ভাব তিনি সংগ্রহ করেছেন৷


ছোটগল্পে চরিত্র একটি গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়৷ রবীন্দ্রনাথ হৈমনত্মী, সোহিনী, রতন, চারম্নলতা প্রভৃতি চরিত্র সৃষ্টিতে সার্থকতা দেখিয়েছেন৷ ‘সমাপ্তি’ গল্পের মৃণ্ময়ীও এরকমই একটি সার্থক চরিত্র৷ মৃণ্ময়ী বাবার আদরের মেয়ে৷ গ্রামে তার নামে অখ্যাতি শোনা যেতো৷ গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে তার খেলা৷ সমবয়সী মেয়েদের প্রতি মৃণ্ময়ীর অবজ্ঞার শেষ নেই৷ শহরে পড়া শিৰিত ছেলে অপূর্ব গ্রামে এসে নৌকা ঘাটে নামতে গিয়ে কাদায় পড়ে যায়৷ আর তা দেখে ইটের ওপর বসে থাকা মৃণ্ময়ী হাসিতে শতধা হয়ে গিয়েছিল৷ প্রচলিত সামাজিক রীতির বিরোধিতা সে খেয়াল বশেই করতো৷ বাবার আদরের কারণেই মৃণ্ময়ীর স্বভাবে দুর্দানত্ম প্রতাপ৷ পুরম্নষ গ্রামবাসীরা স্নেহভরে মৃণ্ময়ীকে ‘পাগলী’ বলে ডাকতো৷ গ্রামের গৃহিণীরা তার উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবে সর্বদা ভীত-চিনত্মিত থাকতো৷ রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘শিশু রাজ্যে এই মেয়েটি একটি ছোটোখাটো বর্গির উপদ্রব বলিলেই হয়৷’


মৃণ্ময়ীর দুর্দানত্ম স্বভাবের পরিচয় পাই রাখালদের বাড়িতে অপূর্বর কনে দেখার মুহূর্তে৷ কনেটি অপূর্বর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, এমনি সময় বাসার বাইরে ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল৷ মুহূর্তের মধ্যে দৌড়িয়ে, হাঁপিয়ে পিঠের চুল দুলিয়ে মৃণ্ময়ী ঘরে এসে প্রবেশ করলো৷ ঘরে প্রবেশ করে কনের ভাই রাখালের হাত ধরে টানাটানি শুরম্ন করে দিল৷ রাখাল উঠতে না চাওয়াতে মৃণ্ময়ী তার পিঠে একটা সশব্দ চপেটাঘাত করে কনের মাথার ঘোমটা খুলে দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল৷ যাওয়ার সময় দ্বারের কাছে রাখা বরের নতুন জুতো জোড়াটি সে নিয়ে গেল৷ পরে পুকুরের ধারে নির্জন পথপ্রানত্মে সে অপূর্বর জুতো জোড়াটি ফিরিয়ে দিল৷ তখন তাকে নির্লজ্জ অপরাধিনীর মতো মনে হলো৷ পলায়নোদ্যত মৃণ্ময়ীকে অপূর্ব দু’হাত দিয়ে বন্দি করে ফেললো৷ মৃণ্ময়ী এঁকেবেঁকে হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্ট করলো কিন্তু পারলো না৷ এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা মৃণ্ময়ীর কৌতুকপ্রিয়তা ও দুরনত্মপনার পরিচয় পাই৷


এক সময় মৃণ্ময়ীর চুল কাঁধ ছাড়িয়ে পিঠের মাঝামাঝি এসে পড়তো; মৃণ্ময়ীর বন্ধু রাখাল একদিন ঝুঁটির মধ্যে কাঁচি চালিয়ে দেয়৷ তখন অত্যনত্ম রাগ করে রাখালের হাত থেকে কাঁচি কেড়ে নিয়ে নিজের অবশিষ্ট পশ্চাতের চুল ক্যাচ ক্যাচ শব্দে নির্দয়ভাবে কেটে ফেলে৷ মৃণ্ময়ীর চরিত্রের মধ্যে এরূপ শাসনপ্রণালী প্রচলিত ছিল৷


মৃণ্ময়ী পাড়াগাঁয়ের অশিৰিত চঞ্চল বালিকা৷ পাড়ার লোকেরা পাগলী মৃণ্ময়ীকে ভালোবাসতো, কিন্তু নিজের পুত্রের বিয়ের যোগ্য বলে কেউ তাকে মনে করতো না৷ এ মৃণ্ময়ীকে অপূর্ব তার ভাবী বধূ হিসেবে নির্বাচন করলো৷ মৃণ্ময়ী মনে করলো তার যেন ফাঁসির হুকুম হয়েছে৷ সে বলে বসলো, ‘আমি বিবাহ করিব না৷’ কিন্তু মৃণ্ময়ীকে বিয়ে করতেই হলো৷ বিয়ের পর শুরম্ন হলো মৃণ্ময়ীর ওপর শাশুড়ির নির্দয় শাসন৷ শাশুড়ির কথা মৃণ্ময়ীর ভালো লাগলো না৷ সে ভাবলো, এ ঘরে যদি তার না চলে তবে বুঝি তাকে অন্যত্র যেতে হবে৷ অপরাহ্নে মৃণ্ময়ী ঘর থেকে বেরিয়ে রাধাকানত্ম ঠাকুরের পরিত্যক্ত ভাঙা রথের মধ্যে গিয়ে বসে পড়লো৷ শ্বশুরবাড়িতে মুক্ত মৃণ্ময়ীর জীবন খাঁচায়বদ্ধ পাখির মতো মনে হলো৷ শাশুড়ির লাঞ্ছনা ও পাড়াপ্রতিবেশীর গঞ্জনায় মৃণ্ময়ীর বিয়ের সিঁদুর, মালার ফুলের রঙ বিবর্ণ হয়ে গেল৷ অপূর্ব যখন মৃণ্ময়ীকে জিজ্ঞেস করে, ‘মৃণ্ময়ী তুমি আমাকে ভালোবাসো?’ মৃণ্ময়ী সতেজে বলে ওঠে, ‘না, আমি তোমাকে ভালোবাসবো না৷’ মৃণ্ময়ীর বিয়ের জীবন যে কী কষ্টের কী যন্ত্রণার তা তার উক্তির মধ্যে ফুটে ওঠে৷ অপূর্ব ৰুণ্ন হয়ে মৃণ্ময়ীকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেন আমি তোমার কাছে কী দোষ করেছি৷’ মৃণ্ময়ী বলে, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করলে কেন?’


শাশুড়ি মৃণ্ময়ীর বিদ্রোহী মন দেখে তাকে ঘরে বদ্ধ করে রাখে৷ মৃণ্ময়ী তখন পাখির মতো ঘরের মধ্যে ধড়ফড় করে বেড়াতে লাগলো৷ অবশেষে কোথাও পালানোর পথ না দেখে নিষ্ফল ক্রোধে বিছানার চাদরখানা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেললো এবং মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়ে মনে মনে বাবাকে ডেকে ডেকে কাঁদতে লাগলো৷ এখানে বিয়ের পরে মৃণ্ময়ীর শৃঙ্খলিত জীবনের অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেয়েছে৷ পরে অপূর্ব ও রাখাল যখন তাকে দরজা খুলে লুকিয়ে পালিয়ে বাইরে যাওয়ার কথা বললো, তখন সে যেতে চাইলো না৷ একবার সে বাবার কাছ থেকে পত্র পেল৷ পত্র পেয়ে শাশুড়িকে বাবার কাছে যাওয়ার কথা বললো৷ শাশুড়ি তার কথার কোনো গুরম্নত্বই দিল না৷ মৃণ্ময়ী তখন নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো৷ নিতানত্ম হতাশ্বাস ব্যক্তির মতো দেবতার কাছে প্রার্থনা করে বলতে লাগলো, ‘বাবা আমাকে তুমি নিয়ে যাও৷ এখানে আমার কেউ নেই৷ এখানে থাকলে আমি বাঁচবো না৷’ বাবার কাছে গেলেই সুখী হওয়া যাবে_ এ চিনত্মা করে গভীর রাতে সে নিদ্রিত স্বামীকে রেখে সংসার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় বাইরে বেরিয়ে পড়লো৷ কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তাকে আবার শ্বশুরবাড়িতেই ফিরে আসতে হলো৷ এরপরে মৃণ্ময়ীর চরিত্রে পরিবর্তন দেখা যায়৷ স্বামীর আহ্বানে সে পালিয়ে বাবার কাছে গেল৷ বাবার কাছে গিয়েই সে পরিপূর্ণ আনন্দ লাভ করলো৷ নৌকোতে ঘুমালো৷ এ ঘুম যেন সুখের ঘুম৷ বাবার প্রতি যে তার কী অপরিসীম ভালোবাসা ছিল তা বাবার সঙ্গে দেখা হওয়া ও তার কাছে আসার ইচ্ছে থেকেই বোঝা যায়৷


অপূর্ব আইন পড়তে যাবে৷ যাওয়ার সময় মৃণ্ময়ীর কাছে পুরস্কার চাইলো৷ অপূর্ব মৃণ্ময়ীকে বললো, ‘তুমি ইচ্ছা করিয়া ভালোবাসিয়া আমাকে একটি চুম্বন দাও৷’ অপূর্বের এই অদ্ভুত প্রার্থনা এবং গম্ভীর মুখভাব দেখে মৃণ্ময়ী হেসে উঠলো৷ হাসি থামিয়ে সে স্বামীকে মুখ বাড়িয়ে চুমু দেয়ার জন্য উদ্যত হলো_ কাছাকাছি গিয়ে আর পারলো না_ খিলখিল করে হেসে উঠলো৷ এভাবে দু’বার চেষ্টা করে সে মুখের ভেতরে কাপড় দিয়ে হাসতে লাগলো৷ এ দৃশ্যের মধ্য দিয়ে অপূর্বর প্রতি তার ভালোবাসাই প্রকাশ পেয়েছে৷ যা সত্যিই অপূর্ব৷ স্বামী চলে গেলে মায়ের ঘরের কোনো কিছুই আর আপন বলে মনে হলো না৷ মৃণ্ময়ীর সেই মধুর হাসি যেন কোথায় চলে গেছে৷ খেলার কথাও তার মনে আসে না৷ গ্রামভর্তি লোক থাকলেও অপূর্বর চলে যাওয়াতে তার মনে হলো গ্রামে কোনো লোক নেই৷ একদিন মৃণ্ময়ী মাথায় কাপড় দিয়ে শাশুড়িকে প্রণাম করলো৷ শাশুড়ি তাকে বুকে চেপে ধরলেন৷ অপূর্বর কলকাতা যাওয়ার সময় যে শাশুড়ি মৃণ্ময়ীকে কাছে রাখতে চাননি, সেই শাশুড়ি পরবর্তী সময়ে মৃণ্ময়ীকে বুঝতে পারলেন৷ মৃণ্ময়ীও শাশুড়িকে বুঝতে পারলো৷ মৃণ্ময়ী বাল্য থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে গম্ভীর সি্নগ্ধ রমণী প্রকৃতি পুরো শরীরে, অনত্মরে রেখায় রেখায় ভরে উঠলো৷ মৃণ্ময়ীর মনে অভিমানের সঞ্চার হলো৷ সে স্বামীকে উদ্দেশ করে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘আমি আমাকে বুঝিতে পারি নাই বলে তুমি আমাকে বুঝিলে না কেন?’ যে মৃণ্ময়ীকে অপূর্ব কৃষ্ণ অনেক চেষ্টা করেও প্রেমময়ী করতে পারেনি, তার মধ্যে পরে নারীত্বের উন্মেষ হওয়ায় সংসারে স্থান হয়েছিল৷ বিয়ের আগের উচ্ছল, উজ্জ্বল হারিয়ে যায় বিয়ের পরে৷ বিয়ের পরের সংসারে টেকার জন্য শুধু পরীৰার পর পরীৰা দেয়৷


শেষ পর্যনত্ম সংসারে তাকে স্থান করে দিয়ে, সংসারে খাপ খাইয়ে দিয়েই যেন মৃণ্ময়ীকে মুক্তি দেন রবীন্দ্রনাথ৷ আমরা যদি সংসারের ও সংসারের বাইরের মৃণ্ময়ীর বৈশিষ্ট্য দেখি, তাহলে প্রকৃত মানুষটি পাই সংসারের বাইরে৷ সেই মৃণ্ময়ীকেই আমাদের হৃদয় আকৃষ্ট করে৷ চুমু বিনিময়ের একটি ঘটনা ছাড়া, সংসারের মৃণ্ময়ীকে পাই যেন মৃত বা জড়পদার্থ রূপে৷ পাড়া বেড়ানো উজ্জ্বল উচ্ছল দুষ্টু মৃণ্ময়ী আমাদের খুব টানে, সংসারের বেড়াজালে তাকে কোথাও আমরা খুঁজে পাই না৷

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান