জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

dw_bigপ্রকৌশলী মো. মাহবুবুল হক
মানুষের মৌলিক চাহিদা-অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সাথে তাল মিলিয়ে এ নগরবাসীর মৌলিক চাহিদার তালিকায় প্রাধান্য পাচ্ছে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, যানজট ও মশার প্রকট যন্ত্রণা। বর্তমানে ১ কোটি জনসংখ্যার বাসস্থান মেগা সিটি ঢাকার পানির চাহিদা দৈনিক ২১০ কোটি লিটার, আর সরবরাহ ১৯৪ কোটি লিটার।

স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক পানির ঘাটতি ১৬ কোটি লিটার এবং শুষ্ক মৌসুমে এ ঘাটতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩০-৩৫ কোটি লিটার। সরবরাহের ৮৫ শতাংশ পানি সংগৃহীত হয় ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে এবং ১৫ শতাংশ সংগৃহীত হয় চাদনীঘাট ও সায়েদাবাদ শোধনাগার থেকে নদীর পানি পরিশোধন করে।

ভূগর্ভস্থ ১৬৫ কোটি লিটারের মধ্যে ১৪০ কোটি লিটার ৪৮৩টি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ও বাকী ২৫ কোটি লিটার ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৩২৬টি নলকূপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ঢাকা শহরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ১২টি পর্যবেক্ষণ কূপের দৈনিক, মাসিক, বাৎসরিক পানির গভীরতা হ্রাস ও বৃদ্ধির তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ১৯৯৬ সালে পানির ন্তর ছিল ২৬.৮ মিটার ২০০০ সালে তা ৩৪.১৮ মিটার এবং ২০০৪ সালে ৫০.১১ মিটার যা প্রতি বছর গড়ে ২.৯০ মিটার পানির ন্তর হ্রাসের হার অব্যাহত থাকলে তা আগামী ২০১০ সালে ৬৮ মিটারে দড়াবে।

তার মধ্যে সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে মিরপুর এলাকা এবং বুড়িগঙ্গার অবদানে ভাল আবস্থায় আছে সূত্রাপুর এলাকা। ভবিষ্যতের ভয়াবহতার কথা বর্ণনা না করে এ পরিস্থিতির কারণ নির্ণয় ও সমাধানের চেষ্টায় আসা যাক।

পরিস্থিতির কারণ

১। শহরের আচ্ছাদিত ও পাকা স্থানের কারণে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া।
২। নগরায়নের শর্তানুযায়ী প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত খোলা জায়গা না থাকায় মাটি বৃষ্টির পানি শোষণ করে ভূগর্ভে প্রবেশের পথ বন্ধ হয়ে যায়।

৩। যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে তার অধিক পরিমাণ উত্তোলন করা।
৪। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া গভীর জলাধারে পর্যাপ্ত পানি প্রবেশ না করা।
৫। ঢাকা শহরের বিদ্যমান ২২টি খাল ভরাট করা।
৬। জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিত আবাসন গড়ার কারণে।

প্রভাব ও ফলাফল

১। নগরের অগভীর ন্তরে পানি রিজার্ভ না থাকার কারণে গাছপালা পানি শোষণ করে বেঁচে থাকার নাগালের বাহিরে চলে যাবে এবং শুকিয়ে মরে যাবে।
২। গভীর জলাধারে পানির ন্তর নিম্নগামী হওয়ার কারণে গভীর ন্তরে ফাঁফা হয়ে যাবে যার ফলে ভূমি ধসের আশংকা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাবে।

৩। গভীর জলাধারের ফাঁফা থাকার কারণে ভূমিকম্পে বেশি পরিমাণে আন্দোলিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
৪। গভীর জলাধারের নিচে বিশাল কাদার ন্তর যার উপরে পানি বালির ভিতর জমে আছে। এ পানি নিঃশেষ হওয়ার পর ক্ষেত্র ভেদে ৩০০-৪০০ ফুট কাদার ন্তর ভেদ করে ১৫০০-২০০০ ফুট নিচ থেকে পানি উত্তোলন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

প্রতিকার

১। বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে প্রবেশের ব্যবস্থা করা।
২। বৃষ্টির পানি বর্ষাকালে রেইন ওয়াটার পাইপের মাধ্যমে রিজার্ভারে রির্জাভ করে ব্যবহার করা।
৩। ঢাকার চারপাশে নদীসমূহ দূষণ মুক্ত করে নদীর পানি শোধন করে সরবরাহ করা।

৪। ঢাকার চার পার্শ্বে নদীসমূহের নাব্যতা ঠিক রাখার জন্য ড্রেজিং করা। কারণ গভীর জলাধার বেশীর ভাগই রিচার্জ হয় গভীর নদী, উজান এলাকা ও পাহাড়ী এলাকা থেকে।
৫। নদীর তীর উঁচু করে উঁচু স্থানে গভীর নলকূপ বসানো যেতে পারে। যার উৎস হতে গভীর জলাধারে পানি প্রবেশ ও উঁচু স্থান থেকে পাম্পে পাইপ নেট ওয়ার্কের মধ্যে পানি সরবরাহ করলে পানির চাপ বৃদ্ধি পাবে।

৬। ভবিষ্যতে নির্মিতব্য বাড়ীসমূহ রান্তা হতে ৫ ফুট উপরে নির্মাণ করে নিচে মাটি বা ভূমি ন্তর উন্মুক্ত রাখা যেখানে বৃষ্টির পানি ও গোসলের পানি রিচার্জ করানো যায় এতে পানির অগভীর ন্তরের সাম্যতা বজায় থাকবে। চিত্র খ অনুযায়ী।
৭। পানীয় জল ও সাধারণ ব্যবহার্য জল সরবরাহ আলাদা করা।

ঢাকার পানি সমস্যা সমাধানে ওয়াসার পরিকল্পনা পদ্মা নদী হতে পানি এনে শোধন করে সরবরাহ করা। কিছু দিন পূর্বে কোন এক সাংসদের মুখে শুনা গেছে বঙ্গোপসাগর থেকে পানি এনে শোধন করে সরবরাহ করা। এখানে প্রশ্ন জাগে পদ্মা বা বঙ্গোপসাগর থেকে পানি আনার খরচের চেয়ে ঢাকার চার পাশের নদী দূষণ বন্ধ করার খরচ কম না বেশী।

এ পর্যন্ত নদী দূষণ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ কি হতে পারে ও এতে ব্যয় কি পরিমাণ দাঁড়াতে পারে এমন কোন জরিপ বা হিসাবের কথা আমার জানা নেই। এ ব্যাপারে ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সিটি কর্পোরেশন তথা সরকার আন্তরিক উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সফল হতে বাধ্য যা নগরবাসীর অন্যতম সমস্যা সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে ঐ দিন বেশী দূরে নয় যে দিন হাতের নিকট পানি হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু পান যোগ্য পানি পাওয়া যাবে না। আর তখনই দেখা দিবে জাতিতে-জাতিতে দাঙ্গা, হানাহানি, দেশে-দেশে যুদ্ধ কিংবা বিশ্বযুদ্ধ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

(লেখক: নির্বাহী প্রকৌশলী)

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান