জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

আনিসুল হক
এক বাবার গল্প বলি। ভদ্রলোকের একটা মাত্র ছেলে। জগতে ওই ছেলে ছাড়া তাঁর আর কেউ ছিল না। নারায়ণগঞ্জে বাড়ি ছিল তাঁর। তিনি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন নারায়ণগঞ্জেই। ১৯৭১ সাল। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ভদ্রলোক নারায়ণগঞ্জ থেকে পালিয়ে গেছেন ত্রিপুরার মেলাঘরে, আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থী ক্যাম্পে। তাঁর তরুণ ছেলেটি যোগ দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে একজন গণযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেয় ছেলেটি। জুলাই মাসেই খালেদ মোশাররফ মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দলকে পাঠান নারায়ণগঞ্জের টানবাজার থানা আক্রমণ করতে। সেই দলে আমাদের এই তরুণটিও ছিল। যেহেতু তারও বাড়ি নারায়ণগঞ্জে, ফলে সে সেখানকার রাস্তাঘাট ভালোই চিনত। অপারেশন সফল হয়। বিজয়ীর বেশেই ফিরে আসছিল এই গেরিলারা। কিন্তু ফিরে আসার সময় এক রাজাকারের হঠাৎ ছুড়ে মারা গুলিতে মারা যায় ছেলেটি।
সেই দুঃখজনক খবরটি আসে মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে। তিনি ব্যথিত ও চিন্তিত হন। তিনি ক্যাপ্টেন এম এ মতিনকে ডেকে বলেন, ‘এই ছেলের বাবা তো পাশেই শরণার্থী শিবিরে থাকেন। তাঁকে ডেকে এনে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানান। আর কিছু টাকা-পয়সা দেন, সান্ত্বনার বাণী শোনান।’
ক্যাপ্টেন মতিন মেজরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করলেন। মেলাঘর প্রশিক্ষণ শিবিরে ডেকে আনলেন সেই বাবাকে। তাঁকে বললেন, ‘সবাইকে মরতে হবে। আগে আর পরে। দেশের জন্য প্রাণ দেওয়া গৌরবের ব্যাপার। আপনার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়েছে।’ ক্যাপ্টেন মতিন লক্ষ করলেন, এই বাবাটি যেন কেমন অন্যমনস্ক। তাঁর কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। মতিন বললেন, ‘দাদা, কী চিন্তা করছেন?’
বাবা বললেন, ‘ভাবতেছি।’
‘কী ভাবতেছেন?’
‘আমি ভাবতেছি ভগবান কেন আমাকে একটা মাত্র ছেলে দিল। আজকে আমার আর একটা ছেলে থাকলে তো আমি তাকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম।’
একমাত্র সন্তানকে হারানোর পর একজন অসহায় পিতার এই ছিল উক্তি। এই ছিল মনোভাব।
আমাদের বাবারা এমনিভাবে আপন সন্তানকে উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের মুক্তির জন্য। আমাদের স্বাধীনতার জন্য।
আর মায়েরা?
আমার মা উপন্যাসের ঘটনাটা আবার বলি। অনেকবার বলেছি, তবুও। এ এমন একটা সময় যখন বারবার মিথ্যা কথা বলে সত্যকে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে। এখন আমাদের সত্যগুলো বলতে হবে বারবার, আবার।
আজাদ ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ঢাকার ইস্কাটনে আজাদদের ছিল প্রাসাদোপম বাড়ি। আজাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলেন। আজাদের মা তাঁর একমাত্র সন্তানকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। অনেক কষ্টে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে লাগলেন। একাত্তর সালে আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করল। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আজাদের বন্ধুরা−রুমি, হাবিবুল আলম, কাজী কামাল প্রমুখ মেলাঘরে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে। তারা ঢাকা শহরে থেকে গেরিলা অপারেশন পরিচালনা করছে। আজাদদের বাড়িতেও তারা আশ্রয় নিতে চায়, অস্ত্র রাখতে চায়। আজাদের মা বললেন, ‘নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু আমার জন্য তোমাকে মানুষ করিনি আজাদ, নিশ্চয়ই তুমি দেশের কাজে লাগবে।’ আজাদদের বাড়িটিও হয়ে উঠল মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গোপন ঘাঁটি। বন্ধুদের সঙ্গে একটা অপারেশনে আজাদ অংশও নিল। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট দিনে আর রাতে ঢাকা শহরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা-বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালাল। আজাদদের মগবাজারের বাড়িতে ছিলেন কাজী কামাল প্রমুখ। তিনি পাকিস্তানি অফিসারের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যেতে সমর্থ হলেও আজাদসহ কয়েকজন ধরা পড়ল।
আজাদকে নিয়ে যাওয়া হলো রমনা থানায়। আজাদের মাকে বলা হলো, ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হবে, যদি সে সবকিছু স্বীকার করে। যদি সে মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের নামধাম ও অস্ত্রের ঠিকানা বলে দেয়। আজাদের মা দেখা করলেন আজাদের সঙ্গে। কিন্তু দেখা করে বললেন সম্পুর্ণ উল্টো কথা। বললেন, ‘শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না।’ আজাদ বলল, ‘মা, কয়েক দিন ভাত খাই না, কাল যখন আসবে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসবে।’ পরের দিন মা ছেলের জন্য ভাত নিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি। আর এই মা যত দিন বেঁচে ছিলেন, কোনো দিন ভাত খাননি। আর কোনো দিন তিনি বিছানায় শোননি। শুতেন মাটিতে একটা পাতলা কাপড় বিছিয়ে। কারণ তিনি জানেন না, তাঁর ছেলে আর কোনো দিন ভাত খেতে পেয়েছিল কি না, কারণ তিনি জানেন না তাঁর ছেলে আর কোনো দিন বিছানায় শুতে পেরেছিল কি না। ১৯৮৫ সালে এই মা মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি বলে যান, তাঁর কবরের গায়ে যেন একটা কথাই লেখা থাকে−শহীদ আজাদের মা। জুরাইন কবরস্থানে এই মায়ের কবরে আজ সেই কথাটাই লেখা আছে।
আমাদের মায়েরাও হাসতে হাসতে তাঁদের ছেলেকে এভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমি। আহা রে দেবদুতের মতো দেখতে বাচ্চা ছেলেটা যে কিনা সবেমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছিল, যখন যুদ্ধে যেতে চাইল, তখন জাহানারা ইমাম তাকে বলেছিলেন, ‘যা তোকে দেশের জন্য কুরবানি দিয়ে দিলাম।’
একজন বাবার জন্য তাঁর নিজের ছেলের প্রাণের চেয়ে বড় কী আছে? বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী কী? পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ। আমাদের বাবারা একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আরেকটা ছেলে কেন নেই, কেন আরেকটা ছেলেকে যুদ্ধে পাঠাতে পারছেন না, তাই নিয়ে আফসোস করেছেন। একজন মায়ের জন্য তাঁর সন্তানের নিরাপত্তার চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? আমাদের মায়েরা হাসতে হাসতে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধে।
আর একজন মানুষের জন্য নিজের জীবনের চেয়ে বড় কী হতে পারে। আমাদের দেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ নিজের জীবন দেশের জন্য উৎসর্গ করতে তখন প্রস্তুত ছিল, হয়ে উঠেছিল অসাধারণ।
ক্যাপ্টেন এম এ মতিনের স্নৃতিকথায় পাচ্ছি একজন নারীর কথা। অক্টোবরের শেষের দিকে বিবির বাজারে একজন নারী পাকিস্তানিদের গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন। তাঁকে বিশ্রামঘরের মুক্তিযোদ্ধা হাসপাতালে আনা হয়। ভীষণ রক্তক্ষরণ হচ্ছিল সেই নারীর। ডা. মোবিন ছিলেন তাঁর পাশে। সেই নারীকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া ডাক্তারের করার তখন কিছুই ছিল না। কারণ, রক্ত জোগাড় করা ওই মুহুর্তে সম্ভব হচ্ছিল না। সম্ভব হচ্ছিল না অপারেশন করাও। ক্যাপ্টেন মতিনও ওই সময় সেখানে উপস্িথত ছিলেন। ভদ্রমহিলা ডা. মোবিনের হাত ধরে একটা অনুনয় করেছিলেন। কী ছিল সেই আকুতিবাণী? তিনি কি বলেছিলেন, ‘ডাক্তার সাহেব, আমাকে বাঁচান?’
না, তিনি বলেছিলেন, ‘দাদা, আমি তো মরে যাব, কিন্তু দেশটাকে স্বাধীন করে যাবেন।’
(ব্রিগেডিয়ার এম এ মতিন, আমাদের সংগ্রাম চলছেই, অপরাজেয় সংঘ থেকে প্রকাশিত)
এ রকম কত যে মহত্ত্বের আর বীরত্বের গল্প আছে।
রুহুল আহমেদ চৌধুরী বাবু নামের সেই টগবগে যুবকের কথাও তো বলা যাবে। সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ। মৌলভীবাজারের বড়লেখা চা-বাগান। পাশেই ভারত সীমান্ত। ক্যাপ্টেন শরিফুল হক আর ফ্লাইট লে. নুরুল কাদেরের নেতৃত্বে রুহুল আহমেদ চৌধুরী বাবু-সমেত মুক্তিযোদ্ধারা চললেন পাকিস্তানিদের একটা ঘাঁটি আক্রমণ করতে। শত্রুর গুলি এসে লাগল বাবুর শরীরে। পাশে সহযোদ্ধা তজমুল আলী। তজমুল বাবুকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছেন সীমান্তের ওপারে। বাবু বললেন, ‘কর কী? আমাকে নিতে গেলে তো তোমার স্পিড কমে যাবে। লাশ কী কাজে লাগবে? আমাকে ছেড়ে দাও।’
তজমুল আলীর চোখে জল। তিনি দেখছেন, বাবু উপুড় হয়ে মাথা ঠেকালেন বাংলার মাটিতে। তারপর গান গাইতে লাগলেন, ‘ও আমার দেশের মাটি। তোমার পরে ঠেকাই মাথা…’
চোখ ভিজে আসে। চোখ ভেসে যায়। কী আত্মত্যাগ! কী বীরত্ব! কত বেশি দামে পাওয়া আজকের এই বিজয়! এই স্বাধীনতা!
পঁচিশে মার্চ রাতের প্রথম শহীদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি কমান্ডার মোয়াজ্জেমের ধানমন্ডির বাড়িতে হামলা চালাল পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে অস্ত্রের মুখে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে আসে। অস্ত্রের মুখে দাঁড় করিয়ে বলে, ‘বল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘জয় বাংলা।’ তখন তাঁর চোয়াল দৃঢ়, দুই হাত শুন্যে উত্তোলিত। একঝাঁক গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দেয় তাঁর শরীর।
তেমনি একটা পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করে শত্রুদের পরাজিত করে ভেতরে দেখা গেল, অনেক মেয়েকে বেঁধে রাখা হয়েছে জানালার শিকের সঙ্গে। মেয়েরা সবাই মারা গেছে। না খেয়ে, অত্যাচারে। তাদেরই একজন রক্ত দিয়ে মেঝেতে দুটো অক্ষর লিখে রেখেছে…হয়তো মৃত্যুর আগে−জ… বা…
মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া, যিনি বাবু আর এই বীর নারীর গল্প শোনান, তাঁর চোখ ছলছল করে। তিনি বলেন, ‘আমরা তো জানি না, মেয়েটির নাম জবা নাকি সে লিখতে চেয়েছিল জয় বাংলা।’ যেমন তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে যখন তিনি পতাকার কথা বলেন। বলেন, সবুজ জমিনে লাল সুর্য, তার ভেতর সোনালি মানচিত্র। ওটাই তো ছিল যুদ্ধের সময় আমাদের পতাকা। অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্ট যুদ্ধ করছে। মৌলভীবাজারের ভানুগাছ রেলস্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে আক্রমণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে পিছু হটছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। এই খন্ডযুদ্ধে জয় লাভ করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকিস্তানিরা পিছু হটলেও পেছানোর সময় কভারিং ফায়ার করছে। আর যুদ্ধজয়ীরা উল্লসিত। হঠাৎ ১৪-১৫ বছরের একটা ছেলের চোখে পড়ল, স্টেশনে এখনো একটা পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। এটা তো সহ্য করা যায় না। ছেলেটা কোত্থেকে একটা বাংলাদেশের লাল-সবুজ মানচিত্র-শোভিত পতাকা জোগাড় করে ফেলল। তারপর তরতর করে উঠতে লাগল ওই খুঁটিতে। পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে সে উড়িয়ে দিল জয় বাংলার পতাকা। হঠাৎই একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল কিশোরের ছোট্ট শরীর। পাকা আমের মতো টুপ করে ঝরে পড়ল ছেলেটা।
মেজর কামরুল বলেন, ‘আজ যখন দেখি পাকিস্তানি ক্রিকেট দলকে সমর্থন করতে পাকিস্তানি পতাকা গালে আঁকছে, সহ্য করতে পারি না। আমাদের পতাকাটা অর্জন করতে আমাদের যে অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল।’
কিন্তু পাকিস্তানিদের পক্ষে অস্ত্র ধরেছিল যারা, তারা তো তখনো ছিল, এখনো আছে। পঁচিশে মার্চের সেই অপারেশন সার্চ লাইটের পর, যখন বুড়িগঙ্গায় মরা মাছের মতো ভাসছিল শুধু মানুষের লাশ, পানি দেখা যাচ্ছিল না, যখন রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়ার পর রোজ ট্রাকে করে স্কুল-কলেজ থেকে মেয়েদের নিয়ে আসা হতো, তখনো যারা পাকিস্তানিদের হয়ে অস্ত্র ধরেছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করেছিল, বাড়িঘরে আগুন দিয়েছিল, ধর্ষণ করেছিল, আর তালিকা করে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল যে আল-বদরেরা, তারা যে এখনো আছে।
‘বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা?’
আনিসুল হক: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান