জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

58323_DeBishnuবিষ্ণু দে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি। রবীন্দ্রনাথের পরে আধুনিক বাংলা কবিতায় নতুন ধারা সৃষ্টিতে তারও ভূমিকা আছে। ১৩৩০ সনের পর বাংলা কবিতায় নতুন ভাব ও নতুন ভঙ্গি দেখা দেয়। যারা প্রধানত এই নতুন ভাবভঙ্গি এনেছিলেন, তাদের বলা হয় তিরিশের কবি। বিষ্ণু দে এদের একজন। অন্যরা হলেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী ও বুদ্ধদেব বসু।
বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালের ১৮ জুলাই (২ শ্রাবণ, ১২১৬ বাংলা) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম অবিনাশচন্দ্র দে এবং মায়ের নাম মনোহারিণী দেবী। বাবা ছিলেন উকিল। বিষ্ণু দে কলকাতারই ছেলে এবং কলকাতায় তিনি পুরো জীবন কাটিয়েছেন। ১৯২৭ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে বিষ্ণু দে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৩০ সালের বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৩২ সালে সেন্ট পলস কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। প্রথম থেকেই তিনি ইংরেজিতে খুব ভালো ছিলেন এবং বিএ পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভালো করার জন্য পুরস্কারও পান। ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাস করেন। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৩৫ সালে কলকাতা রিপন কলেজে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসুকে। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেই বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করেছেন। ১৯৬৯ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। ততোদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অতি সম্মানিত কবি। ১৯৮২ সালের ৩ ডিসেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন।
বিষ্ণু দের স্ত্রীর নাম প্রণতি দে। বিষ্ণু দে ও প্রণতির বিয়ে হয়েছিল ১৯৩৪ সালে।
তরুণ বয়স থেকেই বিষ্ণু দে একজন উদীয়মান কবি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কলকাতায় যেসব নতুন সাহিত্যিকগোষ্ঠী জন্ম নিয়েছিল, তাদের পত্রিকায় বিষ্ণু দে লিখতেন। বিষ্ণু দেই প্রথম স্পষ্টভাবে বলেন, তরুণ কবিদের রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া উচিত। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয় এবং তিনি সুধীন্দ্রনাথের ‘পরিচয়’ পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। পরে তিনি নিজেও ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি রুচিশীল পত্রিকা সম্পাদনা করেন (১৯৪৮)।
বিষ্ণু দে একজন সমাজসচেতন কবি ছিলেন। তার কবিতায় মধ্যবিত্ত মানুষের নানা সমস্যা ও সঙ্কটের কথা রূপ পেয়েছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে তার অনেক বিখ্যাত কবিতা আছে। নাগরিক জীবনের শূন্যতার কথা তিনি তার কবিতায় লিখেছেন। বিষ্ণু দে মার্কসবাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি সমাজের পরিবর্তনে খুব আশাবাদী ছিলেন। সমাজের পরিবর্তন কামনা করে কবি-সাহিত্যিকের ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ গড়ে তুলেছিলেন। এ সংঘের একজন কর্মী ছিলেন বিষ্ণু দে। বিষ্ণু দের কবিতা পড়লে বোঝা যায়, লোকসংস্কৃতির প্রতি তার মনের একটা টান ছিল। সে জন্য আদিবাসীদের জীবন সম্পর্কে তার গভীর আগ্রহ ছিল। একবার বেশ কিছুদিন সাঁওতালদের এলাকায় ছিলেন তিনি। সাঁওতাল ও ছত্রিশগড়িদের নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। বিষ্ণু দে বিখ্যাত ইংরেজ কবি টিএস এলিয়টের দারুণ ভক্ত ছিলেন। তিনি এলিয়টের কবিতা অনুবাদসহ বেশ কয়েকজন আধুনিক ইউরোপীয় কবির কবিতাও অনুবাদ করেছেন। বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্প যামিনী রায়ের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব ছিল এবং যামিনী রায়ের চিত্র নিয়ে তিনি ইংরেজি ও বাংলায় বই লিখেছেন। তিনি একজন মননশীল চিত্রসমালোচক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিত্রশিল্প ও ভারতীয় চিত্রকলা নিয়ে তার ইংরেজি বই আছে।
বিষ্ণু দে একজন দক্ষ কবি ছিলেন। শব্দে ও ছন্দে নৈপুণ্য দেখিয়েছেন তিনি। তার কবিতা পড়লে বোঝা যায়, পুরনো সাহিত্য তার বেশ পড়া ছিল। আধুনিক ইউরোপীয় কবিতার সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। বিষ্ণু দের কবিতার বইয়ের সংখ্যা বিশের অধিক। কবিতার জন্য তিনি বহু সম্মান ও পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাহিত্যে একাডেমী পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার। বিষ্ণু দের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়ছেÑ উর্বশী ও আর্টেমিস (১৯৩৩), চোরাবালি (১৯৩৭), পূর্বলেখ (১৯৪১), সাত ভাই চম্পা (১৯৪৫), সন্দ্বীপের চর (১৯৪৭), অন্বিষ্ট (১৯৫০), নাম রেখেছি কোমল গান্ধার (১৯৫৩), আলেখ্য (১৯৫৮), তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮), স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যত (১৯৬৩), সেই অন্ধকার চাই (১৯৬৬), সংবাদ মূলত কাব্য (১৯৬৯) রুশতী পঞ্চাশতী (১৯৬৭)। অনুবাদকাব্যÑ এলিয়েটের কবিতা (১৯৫৩), হে বিদেশী ফুল (১৯৫৬), মাও সে তুং-এর কবিতা (১৯৫৮) ইত্যাদি।
কবিতার বই ছাড়া বিষ্ণু দের অনেক গদ্য রচনাও আছে। তিনি একজন মননশীল প্রাবন্ধিক ও সমালোচক। তার কয়েকটি ইংরেজি বইও রয়েছে। বিষ্ণু দের প্রবন্ধের বইগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ রুচি ও প্রগতি (১৯৪৬), সাহিত্যের ভবিষ্যৎ (১৯৫২), এলোমেলো জীবন ও শিল্পসাহিত্য (১৯৫৮), রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা (১৯৬৫), মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭), জনসাধারণের রুচি (১৯৭৫), যামিনী রায় (১৯৭৭) প্রভৃতি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান