জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

satyajit rayঅন্তর মম বিকশিত করো অন্তর তব হে
নির্মল করো, উজ্জ্বল করো সুন্দর করো হে।
জাগ্রত করো, উদ্যত করো নির্ভয় করো হে
মঙ্গল করো, নিরলস করো নিঃসংশয় করো হে।
যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ।
সঞ্চার করো সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।
চরণপদ্মে মম চিত্ত নিস্পন্দিত করো হে।
নন্দিত করো, নন্দিত করো, নন্দিত করো হে ।

কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এই গানের লাইনগুলি মনে হয় বাংলা চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়ের জন্য সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। তিনি সত্যিই গণমাধ্যমের এই শক্তিশালী দিকটি আমাদের জন্য পরিবেশন করেছেন এভাবেই।

সত্যজিৎ চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন আমাদের অন্তরকে বিকশিত, নির্মল, উজ্জ্বল ও সুন্দর করার জন্যই। যা কিছু সুন্দর তাই মঙ্গল। একথা মনে রেখেই সত্যজিৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ৩০টি চলচ্চিত্র নির্মান করেছেন আমাদের জন্য।

তিনি শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নয় বরঞ্চ বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এক উল্ল্যেখযোগ্য নাম।

এর প্রতিফলনই আমরা দেখতে পাই ১৯৭৮ সালে বার্লিন ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে। এই উৎসব কমিটিতে তাঁকে সহ তিনজনকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

১৯৯২ সালে তিনি তাঁর অবদানের জন্য চলচ্চিত্র জগতের নোবেল পুরস্কার ‘একাডেমী অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। এই পুরস্কার শুধুমাত্র অসামান্য অবদানের জন্যই প্রদান করা হয়। ছোটবেলায় মানিক নামে পরিচিত এই ব্যক্তিটি মহামূল্যবান মনি-মানিকের মতই ।

পিতামহ ছিলেন শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী। পিতা ছিলেন কীর্তিমান সুকুমার রায় যাঁর লেখা বই ‘হযবরল’ আজও সমভাবে আদৃত সব বয়সের পাঠক পাঠিকার কাছে।

সত্যজিৎ রায় ১৯২২ এর ২রা মে জন্মগ্রহণ করেন কোলকাতায়। তাঁর পূর্ব পুরুষের বাসভূমি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে — যদিও তাঁর পিতামহ জীবিকার তাগিদে উনবিংশ শতাব্দীর শেষে কোলকাতায় পাড়ি দিয়েছিলেন।
তাঁর প্রায় সব ছবির মুখ্য বিষয় হচ্ছে সর্বজনীন মানবতাবাদ। সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের জীবন কথা। এই আবেদনটি এতই সংবেদনশীল যে পৃথিবীর সব দেশের দর্শক তা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছে।

১৯৫৫ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা অমর উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ দিয়ে তার যাত্রা শুরু। গ্রাম বাংলার একটি দরিদ্র পরিবারের চিত্র তিনি নিখুঁতভাবে দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। দর্শকরা হৃদয় দিয়ে অপু-দুর্গার জীবন উপভোগ করেছে। তাদের ছোট ছোট দুঃখ বেদনা নিজের বলে ভাবতে পেরেছে।

তাঁর দু’বছর বয়সে নিদারুণ কালাজ্বরে পিতার মৃত্যুর পর মা সুপ্রভা রায় এবং কাকাদের কাছে মানুষ হন। ছোটবেলা থেকেই সংগীত ও তখনকার দিনের বায়স্কোপের প্রতি আকর্ষণ ছিল। সে সময় সিনেমা বায়স্কোপ নামে পরিচিত ছিল।

কোলকাতার বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতি সহ গ্রাজুয়েশন করার পর চারুকলার উপর লেখাপড়ার জন্য কবি গুরুর শান্তিনিকেতনে যান।
প্রথিতযশা শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর ছাত্র হিসাবে তিনি নিজকে যোগ্য বলেই প্রমান করেন।
১৯৪৩ সালে তিনি বৃটিশ এডর্ভাটাইজিং এজেন্সি ডি জে কেমার এ যোগদান করেন। ১৯৪৯ সালে প্রখ্যাত ফরাসী চিত্র পরিচালক জাঁ রেনোর সংগে দেখা করার পর তাঁর ছবি বানানোর স্বপ্ন সফল হয়। জাঁ রেনো তাঁর ভবিষ্যতের পথ উন্মুক্ত করে দেন। সত্যজিৎ সৌভাগ্যের সোপানে পা রাখেন।

১৯৫০ সালে তিনি ৬ মাসের জন্য লন্ডন যান। ছ’মাস সময়ে তিনি প্রায় ৯৯টি ফিল্ম দেখেন। কিন্তু ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘দি বাইসাইকেল থিফ’ ছবিটি তাঁকে ভীষণভাবে আপ্লুত করে।

এর পরেই তিনি ছবি নির্মানে আগ্রহী হয়ে পড়েন। ‘পথের পাঁচালী’ বইটি নিয়ে ছবি করার আগে এর প্রচ্ছদের ছবি আঁকার সময় তিনি বইটি পড়ে মুগ্ধ হন। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সালে এক অমর সৃষ্টি ‘পথের পাঁচালী’ ক্যান ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালে গ্রান্ড প্রিক্স পুরস্কারে ভূষিত হয়।

ছবির পরিচালক ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান সংগীত পরিচালক। তিনি চিত্রনাট্য রচনা ছাড়াও সাহিত্যিক হিসাবে ১৯৬৮ সাল থেকে বাংলা সাহিত্যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

১৯৬৮ সালে একটি বহুল প্রচারিত সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে ‘ফেলুদা’ ও ‘প্রফেসর শংকু’ দু’টি চরিত্র নিয়ে দুধরণের কিশোর উপন্যাস রচনা করে পাঠক মহলে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।

তাঁর লেখা দুটি উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপও আমরা দেখি ১৯৭৪ এ ‘সোনার কেল্লা’ এবং ১৯৭৮ এ ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’এ।
গত শতাব্দীর আশির দশকে দুটি মারাত্মক হার্ট এ্যাটাক তাঁর কর্মকান্ড স্তিমিত করে দেয়। অবশ্য ১৯৮৮সালে ইবসেনের এনিমি অফ দ্যা পিপল এর ধাঁচে তিনি তৈরী করেন ‘গণশত্রু’। এটিও যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টিকারী ছবি বলে পরিগণিত।

১৯৯২ সালের ২৩ শে এপ্রিল ৭০ বছর বয়সে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের এই বিশাল ব্যক্তিত্ব পরলোকে গমন করেন কোলকাতায় নিজ বাসভবনে। তাঁর মৃত্যুও সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি গগনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হলো। তিনি আরো কিছুদিন আমাদের মাঝে থাকলে আমরা অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষীরা আরো বেশী উপকৃত হতাম।
সত্যি কথা বলতে কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সত্যজিৎ রায় আমাদের পরিচয় যেভাবে বিদেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন, তা হয়ত আর কারো মাধ্যমেই সম্ভব হবে না।
অবশ্য ইদানীং প্রফেসর ইউনুস, প্রফেসর অমর্ত্য সেন এবং পন্ডিত রবিশংকর এ ব্যাপারে উল্ল্যেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন।
পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞাতার্থে সত্যজিৎ রায়ের ৩০টি ছবির নাম প্রদত্ত হলোঃ ১. পথের পাঁচালী (১৯৫৫) ২. অপরাজিত (১৯৫৬) ৩. পরশ পাথর (১৯৫৭) ৪. জলসা ঘর (১৯৫৮) ৫. অপুর সংসার (১৯৫৯) ৬. দেবী (১৯৬০) ৭. তিন কন্যা (১৯৬১) ৮. কাঞ্চনজংঘা (১৯৬২) ৯. অভিযান (১৯৬২) ১০. মহানগর (১৯৬৩) ১১. চারুলতা (১৯৬৪) ১২. কাপুরুষ ও মহাপুরুষ (১৯৬৫) ১৩. নায়ক (১৯৬৬) ১৪. চিড়িয়াখানা (১৯৬৭) ১৫. গোপি গায়েন বাঘা বায়েন (১৯৬৮) ১৬. অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৬৯) ১৭. প্রতিদ্বন্ধী (১৯৭০) ১৮. সীমাবদ্ধ (১৯৭১) ১৯. অশনি সংকেত (১৯৭৩) ২০. সোনার কেল্লা (১৯৭৪) ২১. জন অরণ্য (১৯৭৫) ২২. শতরঞ্জ কে খিলাড়ী (১৯৭৭) ২৩. জয়বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৮) ২৪. পিকুর ডায়েরী (১৯৮০) ২৫. হীরক রাজার দেশে (১৯৮০) ২৬. সদগতি (১৯৮১) ২৭. ঘরে বাইরে (১৯৮৪) ২৮. গণশত্রু (১৯৮৯) ২৯. শাখা প্রশাখা (১৯৯০) আগন্তুক (১৯৯১) ।

মোহম্মদ জাহিদ হোসেন
ফ্লোরিডা, ইউএসএ

http://www.sonalisakal.com/details.php?news_id=1422

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান