জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

মূল: অমর্ত্য সেন, অনুবাদ: ফাইজুল ইসলাম

বাংলার কণ্ঠস্বর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৪১ সালে আশি বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। তিনি হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে একজন বটবৃক্ষ প্রতীম। যারাই এ ভাষার সুবৃহৎ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত তারা বাংলাদেশ ও ভারতে রবীন্দ্রনাথের সম্মোহনী উপস্থিতিতে বিমুগ্ধ না হয়ে পারেন না। কি তার কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ সবকিছুই এখানে ব্যাপকভাবে পঠিত হচ্ছে এবং তিনি যেসব অমর সঙ্গীত রচনা করে গেছেন তা ভারতের পূর্বাঞ্চল ও বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে প্রতিদিন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

তার বিপরীতে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথের যেসব রচনাবলী বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল তার অধিকাংশই এখন ম্রিয়মাণ। সে সময় সারাবিশ্বে তার সাহিত্যকর্ম দিয়ে যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছিল এবং ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। বিশেষ করে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। ঐ বছরের মার্চ মাসে লন্ডন থেকে বইটির ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হয়। নভেম্বর মাসে যখন নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয় ততদিনে ‘গীতাঞ্জলী’র দশ দশটি ইংরেজি সংস্করণ মুদ্রিত হয়ে গেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যে তিনি এখন সেভাবে পঠিত হচ্ছেন না। এমনকি রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশাতেই ১৯৩৭ সালে এসে গ্রাহাম গ্রিন মন্তব্য করেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেলায় ডব্লিউ বি ইয়েটস ব্যতীত আর কেউ তার কবিতাকে এখন আর আন্তরিকভাবে গ্রহণ করছেন কিনা তা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।’

রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে রবীন্দ্রনাথের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা ও বিশ্বের অন্যত্র তার সুনাম ও সুখ্যাতির সার্বিক ঔজ্জ্বল্য হ্রাসের ব্যাপারে তুলনার সম্ভবত কোন গুরুত্ব নেই। কেননা বাংলাদেশ ও ভারতে তিনি এখনো গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক ও নানা বিষয়ে সমকালীন চিন্তাবিদ হিসাবে এখনো স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী। যদিও পাশ্চাত্য জগতে তিনি পুনরাবৃত্তি প্রবণ ও সামান্য মরমিবাদী হিসাবে পরিচিত। গ্রাহাম গ্রিন প্রকৃতপক্ষে তার কবিতার ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন এভাবে যাকে কেষ্টারটন বলেছেন, ঈশ্বর দর্শনে বিশ্বাসী ব্যক্তির সমুজ্জ্বল দৃষ্টিভঙ্গি। ইয়েটস, এজরাপাউন্ড ও রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী অনেক গুণগ্রাহীদের কল্যাণে তাকে পাশ্চাত্যে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে এই মরমীবাদের হাওয়া একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। এমনকি রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ অনুরাগী আনা আখমাতোভা যিনি ১৯৬০ সালের মধ্যভাগে রাশিয়ান ভাষায় তার কিছু কবিতা অনুবাদ করেন, তিনিও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলেছেন, ‘কবিতার যে শক্তিশালী প্রবাহ হিন্দুবাদ ও গঙ্গা থেকে উৎসারিত ও অনুপ্রাণিত তারই নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’

রবীন্দ্রনাথঃ বিভিন্ন সংস্কৃতির সম্মিলিত স্রোতধারা

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতার অভিজাত হিন্দু জমিদার পরিবারে যাদের বেশিরভাগ ভূ-সম্পত্তি ছিল বর্তমানের বাংলাদেশে। কিন্তু আখমাতোভা হিন্দুবাদ ও গঙ্গার নামোচ্চারণ করে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যে জ্ঞান-গরিমা ব্যক্ত করেছেন তাতে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকদের আবাহন থেকে কোন কিছুই নিবৃত্ত করতে পারেনি। না কেউ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তার ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে বিরত রাখতে পেরেছে। যারা আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি হান্টিংটনের ঞযব পষধংয ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ’ং ্র বা সভ্যতার সংঘর্ষ তথ্যের মাপকাঠিতে সমকালীন বিশ্বকে বিচার-বিশ্লেষণ করতে চান তারাও এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে খেই হারিয়ে ফেলবেন। কেননা এখানে মুসলিম, হিন্দু ও পশ্চিমা সভ্যতা পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান করছে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিজের পরিবারের বর্ণনা দিতে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা তাদের আরো ঘোরের মধ্যে ফেলবে। তিনি বলেছেন যে, তার পরিবার হচ্ছে হিন্দু, মুসলমান ও ব্রিটিশ এই তিন সংস্কৃতির সম্মিলিত স্রোতধারার ফল (দ্রষ্টব্যঃ ক্ষিতি মোহন সেন রচিত ঞযব জবষরমরড়হ ড়ভ সধহ, খড়হফড়হ, ১৯৬১: ১০৫, ঐরহফঁরংস, চবহমঁরহ, ১৯৬০ এবং ভারতে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা, কলকাতা, ১৯৯০)।

রবীন্দ্রনাথের পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর আরবি ও ফার্সি ভাষায় পান্ডিত্য অর্জনের জন্য সুপরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে তার পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে সংস্কারবাদী ধর্মীয় সংঘ ‘ব্রাহ্ম সমাজ’-এ অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছিলেন যেখানে সংস্কৃতি ও সনাতন হিন্দু ধর্মগ্রন্থের গভীর জ্ঞানের পাশাপাশি ফার্সি সাহিত্য ও ইসলামী ঐতিহ্য সম্পর্কেও তার ভাল জানাশোনা হয়ে গিয়েছিল। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিভিন্ন ধর্মের সংশ্লেষণে ভিন্ন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিলেন অথবা তার এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল প্রশ্নাতীত। যেমন করে মোঘল সম্রাট আকবর তার দ্বীন-ই-ইলাহী প্রতিষ্ঠায় প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই দৃষ্টিভঙ্গি নাছোড়বান্দার ন্যায় প্রবল ছিল না কিংবা তিনি কোন উপদলেরও সমর্থক ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় দুই শতাধিক গ্রন্থ লিখে গেছেন। এসব গ্রন্থ ভারতীয় বিভিন্ন অঞ্চলের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটসহ সারাবিশ্বের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রভাবের জ্বলন্ত প্রমাণবহ।

শান্তির নিবাস

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অধিকাংশ মহৎ সাহিত্যকর্ম রচিত হয়েছে শান্তিনিকেতনে। শান্তি নিকেতন পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট শহরতলী যেখানে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এর মাধ্যমে তিনি কেবল এক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থারই প্রবর্তন করেননি বরং বিভিন্ন লেখনী ও ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে তার প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যমে এমন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তনে সক্ষম হয়েছিলেন যা ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বিপুল ও বিচিত্রধর্মী কবিতাই লিখেননি, তিনি একজন বড় মাপের ছোট গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অসংখ্য গানের গীতিকার এবং একইসঙ্গে একজন ব্যতিক্রমধর্মী মেধাবী চিত্রশিল্পীও বটে। তার চিত্রকলা সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র ও বিমূর্ত কল্পনার সংমিশ্রণ। এসব চিত্রকর্ম আরো দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য নতুন করে দাবি উঠতে শুরু করেছে। তাছাড়া তার প্রবন্ধগুলোতে সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক পরিবর্তন, ধর্মীয় বিশ্বাস, দার্শনিক বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং এ ধরনের আরো নানা কিছুর প্রতিধ্বনি রয়েছে। ১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উপলক্ষে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রনাথের চিঠির সংকলন প্রকাশিত হয় (কৃষ্ণ দত্ত ও এন্ডু রবিনসন সম্পাদিত বইটির নাম ঞযব ঝবষবপঃবফ খবঃবৎং ড়ভ জড়নরহফৎধহধঃয ঞধমড়ৎব)

এই সংকলনের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত চিন্তার জগৎ ও সে সময়কার নানা প্রতিক্রিয়া আজ সকলের সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি কী ধরনের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তা-ভাবনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা প্রমাণের জন্য এই পত্র সংকলনটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।

মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

যেহেতু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধী দু’জনই বিংশ শতাব্দীতে শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় চিন্তাবিদ ছিলেন, তাই অনেক ভাষ্যকার তাদের পারস্পরিক চিন্তাধারা তুলনার চেষ্টা করেছেন। জওহরলাল নেহেরু তখন ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কারান্তরীণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জেলে বসে তার ডাইরিতে লিখলেনঃ

‘গান্ধী ও ঠাকুর যদিও দু’জনই ভারতের আদর্শস্বরূপ ও মহান ব্যক্তিত্ব, তবু তারা একে অপরের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। ঃআজকের পৃথিবীর মহামানবদের মধ্যে গান্ধী ও ঠাকুর মানুষ হিসেবেও সর্বশ্রেষ্ঠ। আমার সৌভাগ্য এই যে, তাদের দু’জনেরই খুব ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।’

রোমেন রোল্যান্ড দু’জনের মধ্যে তুলনা করতে গিয়ে খুবই বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন। যখন তিনি মহাত্মা গান্ধীর ওপর তার বই লিখার কাজ শেষ করেন, তখন তিনি একজন ভারতীয় শিক্ষাবিদের উদ্দেশ্যে ১৯২৩ সালের মার্চে লিখেন- ‘আমি আমার গান্ধীর ওপর গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছি। এই প্রেক্ষিতে আমি আপনাদের দুই মহান পুরুষ ঠাকুর ও গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’ পরের মাসে তিনি রিভারেন্ড সিএফ এন্ড্রুজ রচিত গান্ধী ও ঠাকুরের কিছু বৈশাদৃশ্য তার ডাইরিতে রেকর্ড করে রাখেন। রিভারেন্ড সিএফ এন্ড্রুজ ছিলেন একজন ইংরেজ যাজক ও জনসেবী। তিনি মহাত্মা গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। এন্ড্রুজ রোল্যান্ডের নিকট ঠাকুর ও গান্ধীর একটি কথোপকথন বর্ণনা করেন যেখানে তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন-

‘তাদের প্রথম আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল দেব প্রতিমা। গান্ধী দেব-দেবীর পক্ষাবলম্বন করলেন। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে যে, জনসাধারণ তৎক্ষণাত বিমূর্ত ধারণার ওপর নিজেদের বিশ্বাস ও মনোবল ধরে রাখতে অপারগ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণ মানুষ চিরকালের জন্য অবোধ শিশুর ন্যায় ব্যবহৃত হতে থাকবে তা মানতে পারলেন না। এই প্রেক্ষিতে গান্ধী উল্লেখ করলেন যে, ইউরোপে মানব সমাজের অনেক মহৎ বিষয় অর্জিত হয়েছে কেবল নিজস্ব পতাকা অর্জনের তাগিদে। পতাকা সে তো প্রতিমারই নামান্তর। ইউরোপের অনেক পতাকা এখনো ঈগলসহ বিভিন্ন প্রাণী তথা দেব-দেবী বহন করে চলেছে। তাদের আলোচনার দ্বিতীয় বিষয়বস্তু ছিল জাতীয়তাবাদ। গান্ধী জাতীয়তাবাদেরও পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, যে কাউকে আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছার জন্য তাকে অবশ্যই জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেমন করে শান্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য পেরিয়ে আসতে হয় যুদ্ধ।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাত্মা গান্ধীর কথাবার্তায় বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও অনেক বিষয়েই তাদের মত পার্থক্য ছিল। যেমন-জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, সংস্কৃতি বিনিময়ের গুরুত্ব। বিজ্ঞান ও যৌক্তিকতার ভূমিকা এবং অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি ইত্যাদি। আমার মতে, এসব মত পার্থক্যের একটি সুস্পষ্ট ও সঙ্গতিপূর্ণ আদর্শিক বিন্যাস আছে। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঐতিহ্যগত দৃষ্টিভঙ্গিকে কম গুরুত্ব দিয়ে সর্বদা যুক্তির পক্ষে অনড় থেকেছেন। এটা ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্য অঞ্চলের সঙ্গে সংহতি রক্ষার স্বার্থেই এবং সাধারণভাবে বিজ্ঞান ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রতি সঠিকতর সম্মান প্রদর্শনের জন্যও তার এই পক্ষাবলম্বন যথার্থ ছিল।

নেহরু তার জেল ডাইরিতে লিখেনঃ ঠাকুর এই সময় মৃত্যুবরণ করে সম্ভবত ভালই করলেন। তাকে ভারত ও সমগ্র পৃথিবীতে ঘটতে যাওয়া অনেক বিভীষিকা আর দেখতে হবে না। জীবদ্দশায় তিনি এসব যথেষ্ট দেখেছেন এবং তিনি এ ব্যাপারে নিরতিশয় দুঃখিত ও অসুখী ছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনের শেষপ্রান্তে ভারত রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের ব্যাপারে সত্যি সত্যি খুব নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের ন্যায় সাধারণ সমস্যার ভারে ভারতকে জর্জরিত হতে দেখে এবং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সংঘর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর বাড়াবাড়ি রকমের ইন্ধন ও উস্কানি দিতে দেখেও তিনি মর্মাহত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর মাত্র ৬ বছর পর ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময় এই সাম্প্রদায়িকতার কারণে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। কিন্তু তার পড়ন্ত দিনগুলোতে তিনি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তার রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করেছিল। লিওনার্দ ইম্পহার্স্ট নামক তার এক বন্ধু ইংরেজ জনহিতৈষী ও সমাজসেবী হিসেবে ব্যাপক নাম করেছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ভারতেও পল্লী উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে একপত্রে লিখেন-

‘লাখ লাখ মানুষের ভাগ্যান্বেষণে পরাজিতন্মন্য ব্যক্তিদের ন্যায় গভীর হতাশা ব্যক্ত করার কোন দরকার নেই। এসব মানুষের সহজাত সংস্কৃতি ও শান্তিপূর্ণ ঐতিহ্য যুগপৎভাবে তাদের ক্ষুধা, রোগ-ব্যাধি, দেশী-বিদেশী শোষণ এবং বিক্ষুব্ধ ও অসন্তোষমূলক সাম্প্রদায়িকতার অধীন করে দিচ্ছে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঁচে থাকলে আজকের ভারত সম্পর্কে তিনি কী মন্তব্য করতেন? তিনি কি এখানে কোন প্রগতি দেখতে পেতেন? না দেখতেন সুযোগের অসদ্ব্যবহার ও এমনকি তার দৃঢ় বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির অকাল অপমৃত্যু? ব্যাপক অর্থে সমকালীন পৃথিবীতে নানা বিচ্ছিন্নতাবাদী সংস্কৃতির প্রসারে তিনি কিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন?

কৌমার্য-ব্রত ও ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী। গান্ধী কৌমার্যব্রত পালনের ব্যাপারে উৎসুক ছিলেন এবং এ ব্যাপারে তত্ত্বও প্রদান করেন। দাম্পত্য জীবন যাপনের কিছুকাল পর তিনি জনসমক্ষে ঘোষণা দিয়ে ব্যক্তিগত অঙ্গীকারে বলেন যে, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে রাত কাটানো থেকে বিরত থাকবেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই আলাদা। তবে তিনি তাদের মতপার্থক্যের ব্যাপারে বিনম্র ছিলেন। তার ভাষায়-

‘গান্ধীজী জীবনের এক পর্যায়ে এসে যৌন জীবন-যাপন বাতিল করে দেন কেবল মানুষের নৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সঙ্গতিপূর্ণ বলে। অবশ্য ঞযব শৎবঁঃুবৎ ংড়হধঃধ গ্রন্থের লেখকের বর্ণনার ন্যায় যৌনতার একটি ভয়ংকর দিক রয়েছে, তবে টলস্টয়ের গল্প এতটা আপত্তিকর নয়। গান্ধী যা তাকে প্রলুব্ধ করে এর বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে এমন বিষয় বরাবরই পরিহার করে চলেছেন। প্রকৃতপক্ষে নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উদার এবং শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে পরিপূর্ণ যা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। তিনি তার আন্দোলনে নারীদের সর্বোত্তম, আস্থাশীল ও অন্তরঙ্গ সহকর্মী হিসেবে গণ্য করেছেন।

নানাভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত জীবন ছিল একজন অসুখী মানুষের প্রতিচিত্র। তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৮৮৩ সালে, স্ত্রীকে হারান ১৯০২ সালে এবং এরপর তিনি আর বিয়ে থা’ করেননি। তিনি অনেকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য কামনা করেছেন। কিন্তু সবসময় এমনকি সম্ভবত বিবাহিত জীবনেও তা পাননি। তিনি একবার তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লিখেনঃ ‘যদি তুমি ও আমি আমাদের সমস্ত কাজ ও চিন্তার সঙ্গী হতে পারতাম, তাহলে তা কতই না তৃপ্তিকর হতো। কিন্তু অনেক সময় আমরা যা চাই তার সবকিছু পাই না।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বড় ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যপ্রেমী স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে সর্বদা উষ্ণ বন্ধুত্ব ও শক্তিশালী নিষ্কাম সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। রবীন্দ্রনাথ তার বিয়ের পূর্বে কিছু কবিতা এবং কাদম্বরীর মৃত্যুর পর বেশকিছু গ্রন্থ তাকে উৎসর্গ করেন। কাদম্বরী রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মাত্র চার মাস পর ২৫ বছর বয়সে কি কারণে আত্মহত্যা করেন তা আজো পুরোপুরি জানা যায়নি।

এর অনেক পর ১৯২৪-২৫ সালে আর্জেন্টিনা সফরকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেধাবিনী ও সুন্দরী ভিক্টরিয়া ওকাম্পো সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। এই ভদ্র মহিলা পরবর্তীতে সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘সুর’-এর প্রকাশক হয়েছিলেন। এক সময় তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যান। কিন্তু ধারণা করা হয় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত কোন একজন বুদ্ধিদীপ্ত নারীর সঙ্গে আঁট বেঁধে যাওয়ার আশংকায় ও আবেগঘন সম্পর্কের সম্ভাবনা থাকায় তাকে এড়িয়ে চলেছেন। আর্জেন্টিনায় তার সফরসঙ্গী ছিলেন বন্ধুবর লিওনার্দ ইল্মহার্স্ট। তিনি এ সম্পর্কে লিখেন:

‘রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গ্রন্থের ওপর গভীর পড়াশোনা ছাড়াও ভিক্টরিয়া ওকাম্পো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধির জোরে বন্ধুত্ব গড়ার পর আত্মতৃপ্ত না থেকে তিনি তার ওপর স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় বেশ তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন। এটা রবীন্দ্রনাথের মোটেই সহ্য হয়নি।’

যা হোক, ভিক্টরিয়া ওকাম্পো নিজেও বিষয়টি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তিনি শারীরিকভাবে রবীন্দ্রনাথের খুব কাছে আসতে চেয়েছিলেন।ঃ

রবীন্দ্রনাথ ও তার প্রতি স্পষ্টভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। তিনি তাকে ‘বিজয়া’ নামে ডাকতেন যা ইংরেজি ‘ভিক্টরিয়া’ শব্দের সংস্কৃত রূপ। তিনি তাকে ‘পূরবী’ নামক একটি কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। পাঁচ বছর পর ১৯৩০ সালে ইউরোপ সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার উদ্দেশ্যে একটি তারবার্তা পাঠালেনঃ ‘তুমি কি আমাকে দেখতে আসবে না?’ ভিক্টরিয়া ওকাম্পো তার ডাকে সাড়া দিয়ে এসেছিলেন বটে কিন্তু তাদের কথাবার্তার বাইরে আর কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তবে আরো কয়েকবছর ধরে তাদের মধ্যে এক প্রকার দ্ব্যর্থক চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে থাকুন, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও আনাড়ি যা হোন না কেন তিনি নিশ্চিতভাবে মহাত্মা গান্ধীর সমালোচনামুখর কামসূচক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে যখন সামাজিক নীতির প্রশ্ন দেখা দিল, তখন রবীন্দ্রনাথ গর্ভনিরোধ ও পরিবার পরিকল্পনাকে সমর্থন করলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে মহাত্মা গান্ধী সংযম প্রদর্শনকেই অধিকতর শ্রেয় মনে করেছেন।

প্রতীচ্য ও পাশ্চাত্য

বিশাল পরিসরে সৃজনশীল নানা অর্জন থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল, পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবমূর্তি যেন অনেকটা সংকীর্ণতায় পরিপূর্ণ। সম্প্রতিকালে তাকে ‘প্রতীচ্যের বড় মাপের মরমী কবি’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটাই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পাশ্চাত্য জগতের চিরাচরিত ধারণায় পরিণত হয়েছে। কেউ কেউ এটাকে স্বাগত জানাচ্ছেন, কেউ পছন্দ করছেন না, আবার কেউ এখনো খুবই বিরক্তিবোধ করছেন। অথচ ব্যাপক অর্থে বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাশ্চাত্যেরই নিজস্ব আবিষ্কার। তিনি প্রতীচ্য বিশেষত ভারতীয় ঐতিহ্যের একটা অংশমাত্র। হেগেলের ভাষায় যাকে বলে ‘হাজার হাজার বছর ধরে ইউরোপিয়ানদের কল্পনায় থাকা’ (আমি আমার ওহফরধ ধহফ ঃযব বিংঃ, ১৯৯৩ ১৯৯৩ এবং ওহফরধহ ঞৎধফরঃরড়হং ধহফ ঃযব বিংঃবৎহ ওসধমরহধঃরড়হ গ্রন্থে এ সম্পর্কে বিশদভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি)। ফেডরিক শ্লেগেল, শেলি, হার্ডার ও স্কোফেনারসহ হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন চিন্তাবিদ এ ধরনের রীতি অনুসরণ করেছেন। তারা প্রথমে এ ব্যাপারে এই তত্ত্ব দেন যে, ভারত ছিল উৎকৃষ্ট জ্ঞানের উৎস। এমনকি এ পর্যায় স্কোফেনার যুক্তি দেখান হয়তো বা নিউ টেস্টামেন্ট বা বাইবেলের উৎপত্তিও ভারতবর্ষে। কেননা এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থটি যেন সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় নীতিশাস্ত্র দ্বারা সত্যায়িত যার নীতিমালা অবশেষে বৈরাগ্যবাদে রূপান্তরিত হয়েছে। ভারতীয় দুঃখবাদ ও অবতারের ধারণা যেন ব্যক্তি মানুষ খ্রিস্টেরই প্রতিরূপ। কিন্তু পাশ্চাত্যের এসব মনীষী এ ধরনের তত্ত্ব দেয়ার কিছুকাল পর অত্যন্ত উদগ্রতার সঙ্গে তারা নিজেদের তত্ত্বকেই প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের প্রত্যাশা অনুসারে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত না হওয়ায় তারা ভারতবর্ষকেও অভিযুক্ত করতে ছাড়েননি। আমরা ভাবতে পারি রবীন্দ্রনাথের সুন্দর, শ্মশ্রুমণ্ডিত ও অপশ্চিমী সাজ-সজ্জা বিশিষ্ট দৈহিক রূপের কারণেই তাদের নিকট হয়তোবা তিনি বহিরাগত জ্ঞানীর উপাধি পেয়ে থাকতে পারেন। জাপানি সাহিত্যে প্রথম নোবেল বিজয়ী ইয়েসুনারি কাওবাতা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তার মাধ্যমিক স্কুল জীবনের স্মৃতি অনুযায়ী ‘ঋষীর ন্যায় কবি’ এই বর্ণনাকে অতি মূল্যবান বিবেচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে রবীন্দ্রনাথকে মরমী কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় তার এই শারীরিক বৈশিষ্ট্য বেশ যুতসই হয়েছে এবং তাকে এভাবে খোপে ভরে রাখাও সহজতর হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের চেহারা সুরতের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে ফ্রান্সেস কর্ণফর্ড উইলিয়াম রোথেনস্টেনকে বলেন, ‘এখন আমি একজন শক্তিশালী ও ভদ্রশিষ্ট যিশু খ্রিষ্টের কথা চিন্তা করতে পারি যা অতীতে আর কখনো দেখেনি।’ ব্রিটিশ ওয়েব রবীন্দ্রনাথকে পছন্দ করতেন না। তার ভাষায়- ‘তিনি দেখতে সুন্দর ও তার কথাবার্তায় স্বরভেদ ও পুনরাবৃত্ত সুর যথার্থ যেন বা তা একজন নাটকীয় সন্ন্যাসির পরিমিতিবোধ।’

পাশ্চাত্যে অন্যদের মধ্যে এজরা পাউন্ড ও ডব্লিউ বি ইয়েটস সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়নে সমবেত কণ্ঠে প্রশংসা করেন। কিন্তু এর কিছুকাল পরে অবজ্ঞা ও এমনকি তীক্ষè সমালোচনায় মুখর হন। ইয়েটস ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলী সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এ সমস্ত গীতিময় কবিতা এমন এক পৃথিবীর কথা ভাবায় যা আমি আজীবন স্বপ্ন দেখে এসেছি।’ তিনি এটাও বলেছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম উৎকৃষ্ট সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু ১৯৩৫ সালে তিনিই আবার ঠাকুরের বিভিন্ন লেখার সমালোচনায় বলেন, উধসহ ঞধমড়ৎব বা ঠাকুরের নিকুচি করি। হতে পারে সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু লিখেছেন এবং তা অনায়াসেও অবিরতভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ইংরেজি ভাষায়ও অনেক লিখেছেন। কিন্তু তারপরও ইয়েটস বিরক্তিবোধ করেছেন। ঃঅবশ্য এজরা পাউন্ড ও অন্য আরো অনেকের ন্যায় ডব্লিউ বি ইয়েটস তার পূর্বের স্তূতিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেননি। ১৯৩৬ সালে তার সম্পাদনায় ঞযব ঙীভড়ৎফ ইড়ড়শ ড়ভ সড়ফবৎহ াবৎংব প্রকাশিত হয়। তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার বেশকিছু কবিতা তাতে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইয়েটস রবীন্দ্রনাথের গদ্য রচনার ব্যাপারেও প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। তবে তিনি রবীন্দ্রনাথের নিজের অনূদিত গীতাঞ্জলী দেখে যে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন তা ছিল এই রকম- ঞধমড়ৎব ফড়বং হড়ঃ শহড়ি ঊহমষরংয, হড় ওহফরধহ শহড়ংি ঊহমষরংয অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি জানেন না। কোন ভারতবাসীও ইংরেজি জানে না। তিনি ইংরেজি ভাষায় গীতাঞ্জলী অনুবাদের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথকে সবিশেষ সহায়তা করেন। এটা সত্য যে, যে কোন ভাষায় কবিতার অনুবাদ খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এমনকি রবীন্দ্রনাথের গদ্য রচনার ইংরেজি অনুবাদও কোন কোন ক্ষেত্রে বিকৃতির শিকার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়ে ১৯১৯ সালে ই,এম ফস্টার লিখেছিলেন, আইডিয়াটি খুবই সুন্দর কিন্তু অনুবাদে হয়তো তার আকর্ষণ হারিয়েছে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সমালোচনার ক্ষেত্রে খুবই সংবেদনশীল ছিলেন। অস্বাভাবিক কোন অভিযোগের কারণেও তিনি ব্যথিত হতেন। এমনই একটি অভিযোগ হচ্ছে ইয়েটস গীতাঞ্জলী নতুন করে লিখেছেন বিধায় নোবেল পুরস্কারের কৃতিত্ব তারও প্রাপ্য। টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিনিধি স্যার ভ্যালেন্টাইন কিরল এরূপ অভিযোগ তুলেছিলেন। ইএম ফস্টার তাকে একজন বৃদ্ধ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ও প্রতিক্রিয়াশীল ভাড়াটে লেখক হিসেবে অভিহিত করেছেন। সময়ান্তরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও এ ধরনের স্থূল ও অতিরঞ্জিত সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। ১৯২০ সালে একবার তিনি সিএফ এন্ডুজকে লিখেনঃ ‘এ ধরনের লোক মদ্যপ প্রকৃতির যারা তাদের স্পষ্ট তফাতের ব্যাপারে ভীত ও সন্ত্রস্ত।’

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান