জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

আহসানুল কবির
শৈল বললে_ আমি তিন চার বছর ধরে অনেক কলেজে চেষ্টা করে দেখেছি- নানা কলেজের অথরিটিদের কাছে গিয়েছি- আমার আট দশ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার কথা বলেছি- তাদের তিনটি কলেজে যে আমার অভিজ্ঞতা তাও বলেছি- কলকাতার বাইরের অন্য অন্য কলেজ দুটোর ভালো ভালো সার্টিফিকেটও দেখিয়েছি- আমাকে বিফল করে দিয়েছেঃ৷ (চৌত্রিশ বছর)৷
‘চৌত্রিশ বছর’ জীবনানন্দ দাশের লেখা উপন্যাস৷ উপন্যাসটি ১৯৩২ সালে কলকাতাতে লেখা৷ উপন্যাসের নায়ক শৈল কুমার মজুমদার৷ কাহিনীর ভেতর তাকে শৈল নামে পরিচিত করা হয়৷ ইংরেজি সাহিত্যে এমএ করা শৈল চাকরি খুঁজতে কলকাতার মেসে থাকে৷ নায়ক চরিত্রের বেকার জীবনের কাহিনী নিয়েই জীবনানন্দের বেশির ভাগ উপন্যাস গড়ে উঠলেও এই উপন্যাসটির ভেতর একটি চরিত্রের কথকতা নানাভাবেই উলিখিত হয়েছে৷ বেকার শৈল গল্পে সমস্যামুক্ত নয়৷ তার আর্থিক অনিশ্চয়তায় তাকে যন্ত্রণাকাতর এবং স্মৃতিকাতরতার মধ্যে সদা মুখর করে রেখেছে৷ গ্রামীণ সমাজ এবং নাগরিক সমাজের ভেতরের জিইয়ে থাকা কঠিন বাস্তবতা গল্পের ভূমি হয়েছে৷ সুদূর পাড়াগাঁর জীবন থেকে বেড় ওঠা শৈল কলকাতার জীবনে প্রতিনিয়ত সংগ্রামশীল৷ বাবা বললেন- কলকাতায় যাও একটা কিছু করো বাবা৷” (চৌত্রিশ বছর)৷ এই বাক্য ধরে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে৷ শৈল বাবার অনুগত পুত্র বলেই বাবার কথা ধরেই সে কলকাতায় রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়৷ তার বয়স এখন ত্রিশ৷ লেখাপড়া শেষ করে বিয়ের পর্বও শেষ৷ তার স্ত্রীর নাম ছায়া৷ ইতিমধ্যে তার দাম্পত্য জীবনে একটি মেয়েরও জন্ম হয়েছে৷ বাবার চেয়ে স্ত্রী ছায়ার চিন্তা আরও বেশি৷ তাই সেও তাকে কলকাতা যেতে উত্‍সাহ জোগায়৷ “একটু দমে গিয়ে মেয়েটি বললে- কোনও চাকরিই কি নেই? কতদিন এরকম বসে বসে কাটাবে৷ কলকাতায় এক একবার যাও আর আসো- কিছুতো হয় না৷” (চৌত্রিশ বছর)৷ শৈল প্রয়োজন এবং সবার তাগিদ বুঝে আবার কলকাতায় রওনা হয়৷ কবি জীবনানন্দ দাশের গ্রাম আর শৈলের গ্রাম একই যার নাম বরিশাল৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই স্টীমার ঘাট এবং সেখান থেকে খুলনায় এসে ট্রেনে চেপে বসা৷
স্টিমার যাত্রা এবং স্টিমারের পরিবেশসহ বাইরের নদী প্রকৃতি আকাশ বাতাসের বর্ণনার মাধ্যমে উপন্যাসে শৈল চরিত্রের কবি স্বভাবের প্রকাশ ঘটেছে৷ “সন্ধ্যার অন্ধকারে মেঘে স্টিমারের ভিতর একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছিল৷ তার ওপর বৃষ্টির ঝাপটা৷ এই ঘনঘটার ভেতর ফ্ল্যাটের দরজার ছাদের থেকে ছোট ছোট বাতিগুলো যেন চুপসে চুন হয়ে কালি হয়ে মুছে যাচ্ছে৷ পচা ইলিশ মাছ- চিংড়ির গন্ধ আখের ছিবড়ে সুটকি- চিংড়ি- পাট আর চটের পর্দার চামসে গন্ধ ইতস্তত সোচ্চার- নিষ্ফলতা শৈল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনুভব করছিল সব৷” (চৌত্রিশ বছর)৷ এমন বর্ণনার সাথে রোমান্টিক প্রকৃতি প্রেমী জীবনানন্দ দাশের মির খুঁজে পাওয়া যায় না৷ তবে গদ্য এবং কাহিনীর সাথে জীবন যখন সম্পৃক্ত হয়ে পড়ে তখন তার বৈশিষ্ট্য এভাবেই ফুটে উঠতে পারে৷ এই ব্যাখ্যা এবং বর্ণনার সাথে আমরা পদ্মা নদীর প্রথম মাঝি রবীন্দ্রনাথের গল্প গুচ্ছের কোন কোন ক্ষেত্রে মিল পাই৷ “যখন গ্রামের চারদিকের ভেসে বেড়ায় পাট পচানির গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত, উলঙ্গ, পেটমোটা পা সরু রুগন ছেলে মেয়েরা এখানে সেখানে জলে কাদায় মাখামাখি ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকেঃ৷” (সুভা : রবীন্দ্রনাথ)৷ পদ্মা নদীর দ্বিতীয় মাঝি মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের বাস্তবচিত্র বর্ণনার এমস মিলও খুঁজে পাওয়া যায়৷” এক ছেলের মুখে স্তন খাওয়ানোর শখ মালার একার নয়, এমনিভাবে খাওয়াইয়া না দিলে ওরা খাইতে চায় না৷ মালা এসব কথা বলে৷ মালার মাথায় উকুন গায়ে মাটি, পরনে ছেড়া দুর্গন্ধ কাপড় তাই এ সময়টা সে যে কত নিখুঁত ভদ্রমহিলা, অসামাঞ্জস্য তাহা স্পষ্ট করিয়া দেয়৷ চন্ডী উলঙ্গ চকচকে ভিজা ভিজা গায়ের চামড়া৷” (পদ্মানদীর মাঝি)৷
দুটি উপন্যাসেই ত্রিশোত্তর কালের বলে এর ভাষা এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে কিছু মিল পড়লেও দু’জন ঔপন্যাসিকের বিষয় ভাবনা আলাদা৷ ‘পদ্মানদীর মাঝি’র নায়ক কুবের অশিক্ষিত মাঝি আর ‘চৌত্রিশ বছর’ উপন্যাসের নায়ক শৈল শিক্ষিত ইংরেজিতে এমএ পাশ করা বেকার মানুষ৷ একজন গ্রামীণ জীবনে সংগ্রাম করছে আর একজন নগর জীবনে সংগ্রামরত৷ মানিক বন্দোপাধ্যায় তার উপন্যাস সৃষ্টিতে যতখানি নিরপেক্ষ জীবনানন্দ দাশ চরিত্র চিত্রনে ততখানি নিরপেক্ষ নন৷ নায়ক শৈলের জন্মস্থান থেকে বাড়ি, বাবা-মা স্ত্রী কন্যা কলেজের চাকুরি, চাকুরি চলে যাওয়ার ঘটনা সবই জীবনানন্দ দাসের জীবনেরই অনুরূপ হয়ে এসেছে৷ তাই চৌত্রিশ বছর উপন্যাসটি জীবনানন্দ দাশের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বললেও ভুল হবে না৷ সাহিত্য যে কখনও কখনও ইমিটেশন অব লাইফ হয়ে ওঠে তা আবারও জীবনানন্দ দাশের কাছে এসে আর একবার প্রমাণিত হল৷ দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, দেশভাগের পূর্বাভাস, চাকরি জীবনের অনিশ্চয়তা থেকে পারিবারিক জীবনের অশান্তিএবং তার সৃষ্টি কবিতার বিরুদ্ধে অশীলতার অভিযোগ এনে চাকরিচু্যতি নারী প্রেমে ব্যর্থতা প্রভৃতি বিষয়ের ভিন্ন ভিন্ন বিস্ময়, অপ্রাপ্তি, ক্ষোভ, জিজ্ঞাসা হীনমন্যতা মিশ্রিত ব্যাখ্যায় ‘চৌত্রিশ বছর’ উপন্যাসের কাহিনী হয়েছে৷ কাহিনীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্তনায়ককে আমরা তার বাড়ি গ্রাম এবং পরিবারের মধ্যে স্বল্প সময়ই থাকতে দেখেছি৷ স্টিমার এবং ট্রেনের প্রায় চবি্বশ ঘণ্টার ভ্রমণে তাকে আমরা সুস্থ সবল দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক জীবনমুখি কবি বলে চিনতে পারি৷ “পৃথিবীর পথে পথে মানুষের প্রাণের সংগ্রাম, চেষ্টা, আশা-আকাঙ্খা, নির্যাতন, বিরহ, বেদনা ও জীবনের বিরাট প্রাণস্ফূর্তিতে বাঁচিয়ে রাখছে এই নদীর দিকে তাকিয়ে অনেক কথা মনে হয়ঃ৷” চৌত্রিশ বছর)৷
স্টিমারের মধ্যে যাত্রী সংখ্যা বেশি হলেও সবার মধ্যে কমবেশি সহযোগিতার মনোভাব রয়েছে৷ হিন্দু মুসলিমের প্রসঙ্গ এসেছে- অসাম্প্রদায়িক চেতনার দ্বারা হজ্ব ফেরত একজন মুসলমানকে দিয়ে বলানো হয়েছে- হিন্দুরা যেমন গাঁটের কড়ি ভেঙ্গে কাসীতে গিয়ে মরতে চায় আমাদেরও তেমিন মক্কা শরিফে গিয়ে শহিদ হতে হয়ঃ৷” (চৌত্রিশ বছর) নদীর দুই ধারের প্রাকৃতিক যে বর্ণনা চিত্রিত হয়েছে তা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের৷ আমন ধানের ক্ষেত, সাইবাবলার ঝাড়, ঝুমকোজবার গাছ, অপরাজিতার বন, খেজুর গাছ, মাদার গাছ, গাভী, পাখি, মধুমালতির ঝাড়, গ্রাম্য বৌ-এর চলা, শঙ্খচিলের ট্রেনের সঙ্গে পালা দেয়ার দৃশ্য ইত্যাদি ইত্যাদি৷ “আকাশে অনেক মেঘ- ছিঁড়ে ছিঁড়ে পুবে দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়েছে; ছোট বেলার সেই হাসি-হাসি পাড়ার মেয়েদের মতো- বোনদের মতো-এক একটা তারা যেন শৈশবের জীবনকে বিগত কুড়ি-পঁচিশ বচর আগের এক একটা মাছের-৷” (চৌত্রিশ বছর)৷
“আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি
আবার বছর কুড়ি পরে-
হয়তো ধানের ছড়ার পাশেঃ৷” (কুড়ি বছর পরে)৷ এমন প্রত্যাশার প্রদীপ জ্বালানোর কাজ তিনি কবিতাতে এবং গদ্যে বারবার করেছেন৷ নায়ক শৈল কবি হূদয়ের বেকার, পুরুষ জীবনে করেছেন কম কিন্তু যা দেখেছেন তার চেয়ে বর্ণনা করেছেন বেশি৷ নায়কের জীবনে মেসের জীবনই শেষ পর্যন্তআশ্রয় হয়ে রয়েছে৷ এখান থেকেই কাহিনীর বিস্তার বর্ণনা ধারাভাষ্যের মত শৈলের মুখ থেকে নির্গত হতে থাকে৷’ একটা ঘর ছিল ম্যানেজার ঘরটা মন্দ নয়- একটা গুদামের মতো- অনেকগুলো চায়ের বাক্স পড়ে রয়েছে- কতগুলো কেরোসিনের টিনে চুন সুরকি রং ম্যানেজার বললে এই ঘরে কয়েকদিন থাকুন, এর মধ্যে দু-চারটে কামরা খালি হয়ে যাবে- তখন রিমুভ করতে পারবেনঃ৷” (চৌত্রিশ বছর) এই মেসের জীবনকে অবলম্বন করেই নায়ক চরিত্রের আকাঙ্খা প্রচেষ্টা বাড়তে থাকে৷
সেই মতো তার সংগ্রাম করার অভ্যাস তৈরি হয়৷ পায়ে হেঁটে ট্রামে বাসে চাকরি খোঁজার নিরলস প্রচেষ্টার পাশাপাশি টিউশনির জন্যেও সাক্ষাত্‍কার দেয়অ অব্যাহত থাকে৷ পূর্বের হারানো চাকুরি ফিরে পাওয়ার জন্যেও চেষ্টা নেয়া৷ এছাড়া চাকরি হারানোর কারণও স্পষ্টভাবে ক্ষোভের সাথে উলেখ করা হয়েছে৷ “শৈল শুনেছিল, যে কলেজে সে কয়েক বছর টিচারি করেছিল, তার কবিতা অশীল বলে একদিন যারা তাকে কানাঘুষা করে ছাড়িয়ে দিয়েছে- মুখে বলেছে ছাত্র কমে যাওয়া স্টাফ কমাতে হল- তাদের নাকি ছাত্র বেড়ে গেছে আবার নতুন লোকের দরকার হয়ে পড়েছে- খবরের কগজে দেখল, তারা লেকচারারদের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে৷ শৈল বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজটা পাশে রেখে অনেকক্ষণ ভাবল সেখানে যাবে কিসে?” (চৌত্রিশ বছর)৷ “১৯২৮ সালে সবচেয়ে কনিষ্ঠ অধ্যাপক জীবনানন্দ সিটি কলেজের চাকরি থেকে বরখাস্তহলেন৷ অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়৷ ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় সংবাদ সাহিত্য বিভাগে সজনীকান্ত দাস অশালীন ভাষায় জীবনানন্দের কবিতাকে তীব্র আক্রমণ শুরু করেন৷

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান