নিবেদিত রায়
রাত বারোটা বাজলেই কথা বলুন মাত্র ০০.৬০ ও ০০.৫০ ও ০০.২৫ পয়সায়। রাস্তার ধারে বড় বিল বোর্ডে এই বিজ্ঞাপনের অর্থ অল্প খরচে কথা বলার সুবিধা গ্রহণ করুন।
মোবাইল বা মুঠোফোনের জনপ্রিয়তা এখন বর্তমান প্রজন্মের কাছে তুঙ্গে। মোবাইল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্যাকেজ ছাড়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে। গভীর রাতে এসব কোম্পানি বিশেষ সুবিধার ব্যবস্থা রেখেছে। রাত বারোটা বাজার পরই মোবাইল ফোনের ব্যারোমিটারে ইউনিট হিসাব হয় পয়সায়। ভোরের আলো শুরু হতেই ইউনিটের পয়সার পরিমাণ বেড়ে টাকায় পরিণত হয়। সারাদিনের পরিশ্রম, ব্যস্তময় জীবন, লেখাপড়া, দৈনন্দিন কাজের অবশেষে সবাই যখন দেহ মনের ক্লান্তিকে প্রাশান্তি দিতে ঘুমের দেশে হারিয়ে যায় তখন মুঠোফোনের রিং অথবা ভাইব্রেশনে ঘুমের সময়টি ও মোবাইলের মতো অস্থির হয়ে পড়েন অনেকে। মোবাইল ফোনগুলোর দেয়া এসব ছাড় ও সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন স্তরে একাধিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকের মতে একটি প্রশ্ন হচ্ছে, এতে লাভবান হচ্ছে কারা এবং পক্ষান্তরে ক্ষতি হচ্ছে কার?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী শম্পা শারমিন। তিনি তিনটি সিমের অধিকারী। ডিজুস যখন রাতে কথাবলার ফ্রি সুযোগ দিয়েছিল সে সময়ের একটি অভিজ্ঞতা তিনি বললেন, ‘একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে রাত এগারোটার পরে আমার কাছে ফোন আসত। ছেলেটির কণ্ঠস্বর ও বাচনভঙ্গি সুন্দর। রাতে ফ্রি টকটাইম শুরু হলে আমাদের কথা বলাও শুরু হয়ে যেত। প্রায় সারারাত কথা চলত। একমাসে ফোনের এই বন্ধুত্ব প্রণয়ের সম্পর্কে পরিণত হয়। এভাবে একদিন আবিষ্কার করলাম ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। দেখা করার কথা বললে সে এড়িয়ে যেত। এরপর তার ঠিকানা অনুসারে গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানলাম সে বিবাহিত এবং এক ছেলের বাবা।’ এরপরের ঘটনা আরও করুণ। শম্পা বললেন, ‘আমি চেষ্টা করলেও রাতে কথা বলার পুরাতন অভ্যাস ত্যাগ করতে পারতাম না। এরপর অসুস্থ হয়ে যাই, বাবা-মা বাড়িতে নিয়ে যায় এবং অনেকদিন পরে আমি এখন অনেকটা স্বাভাবিক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা খানম বললেন, ‘রাত জেগে ফোনে মূলত টিনএজ এবং তরুণ বয়সী ছেলেমেয়েরা কথা বলতে পছন্দ করে। খুব অর্থে ফোন কোম্পানিগুলো এই বয়সটিকে আকর্ষণ করে। কিন্তু মধ্য বয়সী ও অন্যান্য বয়সী ব্যক্তিরা প্রয়োজনীয় কথা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ করে এবং রাত জেগে গল্প করার জন্য তারা অপেক্ষা করেন না।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিটি মোবাইল ফোন কোম্পানি তাদের প্যাকেজে তরুণ প্রজন্মকে লক্ষ্য রেখে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। এই সুবিধাগুলো হচ্ছে, রাতে ফোন বিল কম থাকা, গ্রুপিং করে কথা বলার সুবিধা কিংবা দু-তিনটি নাম্বারে কম মূল্যে কথা বলা। লক্ষ্য করা যায় প্রতিটি সুবিধা রাত ১২.০০ থেকে সকাল ৬.০০টা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। যার কোন ইতিবাচক দিক নেই কারণ আমরা দিনে কাজ করি ও রাতে ঘুমাই এতে আমাদের মস্তিষ্ক অভ্যস্ত, এর ব্যতিক্রম ঘটলে শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। রাতে যারা কথা বলে দেখা যায় কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তারা জেগে কথা বলার ফলে শারীরিক, মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি সামাজিক আদর্শ থেকেও তার বিচ্যুত হয়।’ তিনি জানালেন, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার করা উচিত এবং মোবাইলের ব্যবহারে ফোন কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টিও ভেবে দেখা উচিত।
১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম মোবাইল ফোন গ্রামীণের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এর গ্রাহক সংখ্যা এক কোটি ষাট লাখ। ২০০৭ এর জুলাই পর্যন্ত এই কোম্পানির স্মাইল প্যাকেজের গ্রাহক এক কোটি। গ্রামীণের পরই ১৯৯৭ সালের ১৫ নভেম্বর একটেল যাত্রা শুরু করে, ২০০৭ এর সেপ্টেম্বরে যৌথ মালিকানার এই ফোন কোম্পানিটির গ্রাহক সংখ্যা এখন অর্ধ কোটি। এর সঙ্গে ১৯৯৩ সালে সিটিসেল, ২০০৫ এর ১০ ফেব্রুয়ারি বাংলালিংক যাত্রা শুরু করে এবং বর্তমানে দুটি টেলি কোম্পানির গ্রাহক সংখ্যা একত্রে পঞ্চাশ লাখ ছড়িয়ে যায়। এসব কোম্পানির ভিড়ে একমাত্র দেশীয় মুঠোফোন প্রতিষ্ঠান টেলিটক ২০০৪-এর ২৯ ডিসেম্বর বাজারে আসে এবং এর বর্তমান গ্রাহক সংখ্যা দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার। সর্বশেষ মোবাইল ফোন কোম্পানি ওয়ারিদ এ বছরেই (২০০৭) যাত্রা শুরু করে এবং মাত্র সত্তর দিনের মাথায় দশ লাখ গ্রাহকসেবায় পেঁৗছে যায়। দেখা যায় রাতের বেলায় কম টাকায় কথা বলার সুযোগ রাখায় তরুণ প্রজন্ম একাধিক কোম্পানির সিম ব্যবহার করে।
দুই সন্তানের জনক ঢাকার রায়ের বাজারের বাসিন্দা আবু সুফিয়ান। তার বড় দুই ছেলেমেয়ের বয়স যথাক্রমে বিশ এবং ষোল। সন্তান ও মোবাইল নিয়ে তিনি জানালেন, তার পরিবারের চার সদস্যের চারটি মোবাইল আছে। মোবাইলের ব্যবহার আজকাল ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, যন্ত্রণারও শেষ নাই। তিনি বলেন, ‘সকালে উঠে দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতার অর্ধেক জুড়েই মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। প্রতিটি কোম্পানি একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সুন্দর সুন্দর সংলাপ আর বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয়। গণমাধ্যমগুলো যে কোন অসঙ্গতিকে সবার সামনে তুলে ধরে কিন্তু কখনোই কোন গণমাধ্যম ফোন কোম্পানিগুলোর সামাজিক দায়িত্ববোধ, মোবাইল ব্যবহারের অসচেতনতাকে প্রকাশ করে না। বলা যায়, বিপুল অংকের অর্থ দিয়ে মিডিয়াকে কিনে নিয়েছে ফোন কোম্পানিগুলো।’
কলাবাগানের অর্চনা রায় এমনি একজন চিন্তিত অভিভাবক। তার ছেলে দশম শ্রেণীর ছাত্র সিদ্ধার্থ সংকর রায় অষ্টম শ্রেণীর থেকে মোবাইল ব্যবহার করে। সিদ্ধার্থের মা অর্চনা রায় জানালেন, ঢাকা শহরের যানজট, পত্রিকার পাতায় নিত্যদিনের দুর্ঘটনা এসব কারণে ছেলে স্কুলে বা প্রাইভেট পড়তে গেলে দুঃচিন্তা হয়। এজন্যই ছেলেকে মোবাইল কিনে দেয়া হয়। কিন্তু ছেলের মোবাইল ব্যবহারের কারণে এখন অন্য একটি চিন্তায় সারাক্ষণ ভয়ে থাকতে হচ্ছে। ছেলে আলাদা রুমে থাকে এবং রাত জেগে মোবাইলে কথা বলে। অর্চনা রায় বললেন, ‘ছেলেকে শাসন করলে বলে স্কুলের পড়া তৈরি করছি। রাত জাগার কারণে সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, সারাক্ষণ ক্লান্ত থাকে, অবসর সময়ে গল্পের বই বা খেলাধুলা না করে মোবাইল সঙ্গে করেই সময় কাটিয়ে দেয়।’ মোবাইলের কারণে লেখাপড়ার সমস্যা হয় কিনা সংকর প্রশ্নটি এড়িয়ে বলল, ‘মোবাইল ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয়। রাতের বেলা অল্প খরচে কথা বলা যায় তখন আমরা গ্রুপ কল করে কথা বলি। তবে তাদের আলাপের বিষয়বস্তু বলতে চায়নি। এমনকি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে না ছেলেদের সঙ্গে কথা বলে তাও বলল না।’
মোবাইল নিয়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনাও চোখে পড়ে পত্রিকার পাতায়। মোবাইল সেটের কারণে ভাইবোনের মধ্যে ঝগড়া লেগে সমপ্রতি আত্মহত্যা করেছে একজন। পথে-ঘাটে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে শখের ফোন সেটটি হারিয়ে মনঃক্ষুণ্ন্ন হচ্ছেন অনেকে। আবার মোবাইল সেট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে মারাত্মক হামলার শিকার হয়েছেন অনেকেই। সমপ্রতি ভারতে দুটি অঙ্গরাজ্য কর্নাটক ও কেরালার রাজ্যসভা ষোল বছরের কম বয়সীদের কাছে মোবাইল বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। আমাদের দেশের অনেক অভিভাবকও মনে করেন আমাদের দেশেও এই আইন করা উচিত।
একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর মোবাইল ব্যবহারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র তৌহিদুল ইসলাম বললেন, ‘অসচেতনতা থেকে অনেক ধরনের দুর্ঘটনা হয়। রাতের সময় দীর্ঘ আলাপে শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি নৈতিকতা বিরোধী আচরণ প্রকাশ পায়। ছেলেমেয়েরা আগে লেখাপড়ার জন্য নিশিযাপন করত কিন্তু এখন মোবাইলে কথা বলার জন্য নিশিযাপন করে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা দিবা বলেন, ‘রাত জেগে মোবাইল ফোনে কথা বলার কারণে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হয়। শরীর বিশ্রাম চাইবে তার সময় অনুযায়ী। দেহঘড়ি ও শরীর দুটো দু’রকম কাজ করে। রাত জেগে কথা বলার ফলে শরীরের ক্ষমতা অতিদ্রুত ক্ষয় হয়ে যায়। দিনের বেশিরভাগ সময় ক্লান্তি ঝিমুনি থাকে, ব্যক্তি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় ফলে কাজে মনোযোগ দিতে পারে না। রাত জেগে থাকতে অতিরিক্ত চা, কফি গ্রহণ করার জন্য দেহঘড়ি এসবের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শরীরে পানিশূন্যতা সৃষ্টি করে। এ সব কারণে দেহে বিরাট চাপের সৃষ্টি হয়, মানসিকভাবে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের মাত্রা কমে যায়। এ কারণে বিষণ্নতা তৈরি হয়, এর প্রভাব পড়ে সামাজিক ক্ষেত্রে। সেই ব্যক্তি নিজেকে অন্যদের কাছে গুটিয়ে ফেলে। খেলাধুলার মতো কষ্টকর কাজ থেকে দূরে থাকে। দেখা যায় ভাল বন্ধু তৈরি হওয়ার সুযোগও নষ্ট হয়।’ এই নেতিবাচক দিকগুলোর প্রতিকার সম্পর্কে ফারহা দিবা বললেন , ‘সন্তানদের ইতিবাচক কাজে উৎসাহ দিতে হবে, মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে এবং কোন বয়সের ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল দিতে হবে এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে।’
মন্তব্য করুন