নাসিমা হক
শম্ভুমিত্র চরণদাস চোর বারবার দেখতে আসতেন। বলতেন, ‘হাবিব জানে না, ও কী করেছে’। শেক্সপিয়র, ব্রেখটের অন্দরে ছত্তিশগড়ি নাচ, লোককথার অনায়াস যাতায়াত। আলোচিত নাটকগুলো ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য অন্য নাটকের মধ্যে রয়েছে পঙ্গা প-িত, রাজরক্ত। নব্বইয়ের দশকে ধর্মীয় ভ-ামির বিরুদ্ধে তার পঙ্গা প-িত উগ্র হিন্দুদের খুবই ক্ষুব্ধ করেছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে সারা ভারতে তিনি নাটকটি সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চায়ন করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটক ও রাজর্ষি উপন্যাস অবলম্বনে তিনি রাজরক্ত নাটকটি লেখেন ও পরিচালনা করেন।
চলে গেলেন ভারতের প্রখ্যাত নাট্যকার হাবিব তানভীর। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই নাট্যকার সুদীর্ঘকাল নাট্যনির্মাণে নিমগ্ন ছিলেন। নাটক নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। ভারতের নাট্যজগতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হাবিব তানভীরের জীবনাবসান হয়েছে গত ৮ জুন ৮৫ বছর বয়সে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভূপালের ন্যাশনাল হাসপাতালে। নাটকের ক্ষেত্রে কাজের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন হাবিব।
হাবিব তানভীর ঢাকায় এসেছিলেন তার নাট্যদল নিয়ে। শিল্পকলা একাডেমীতে পরপর দুই রাত তার অসামান্য প্রযোজনা আগ্রাবাজার ও চরণদাস চোর দেখেছিলাম। অসামান্য সেই নাট্যসৃষ্টি ভোলার নয়। আগ্রাবাজার, মির্জা গালিবের আমলের এক কবির জীবন তিনি এ নাটকে রূপায়িত করেছিলেন। এতো চমৎকার সেট যেন মঞ্চের মধ্যেই একটা বাজার বসে গিয়েছে। চরণদাস চোর বহু বছরব্যাপী মঞ্চস্থ হয়েও সমান জনপ্রিয় ছিল। হাবিব তানভীর তার নাটকে অভিনেতা বা কুশীলব হিসেবে যাদের নিয়ে এসেছিলেন, তারা ছত্তিশগড়ের সাধারণ দেহাতি মানুষ। মঞ্চের বাইরেও নানা অনুষ্ঠানে তখন তাকে ও তার দলকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। শিল্পীরা গায়ের সাধারণ মানুষ। তাদের পোশাক-আশাক খুবই সাধারণ। পায়ে স্পঞ্জের ছেঁড়া চপ্পল। এরা কেউই মঞ্চের নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন না। কিন্তু মঞ্চে এদের দিয়েই হাবিব করিয়ে নিয়েছিলেন অসাধারণ অভিনয়। নাট্যকুশলীরা নিজেরাই হাতে হাতে মঞ্চের সেট তৈরি করেছি। আধুনিক নাট্য ও লোকনাট্য মিশিয়ে অসাধারণ এক নাট্যসৃষ্টি উপহার দিয়েছিলেন নাট্যকার হাবিব তানভীর। তার নির্দেশনার গুণে জীবনে প্রথম মঞ্চে পা রাখা এই দেহাতি মানুষগুলো অসাধারণ অভিনয় করে নাটকটিকে প্রাণ দিয়েছিলেন। চরণদাস চোর বলা যায় একটি রাজনৈতিক স্যাটায়ার। আমাদের সময়ের রাজনীতির দৈন্যদশাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ওই নাটকে। আজকের দিনেও তা সমান প্রযোজ্য।
আগ্রাবাজার নাটক দিল্লিতে যখন মঞ্চস্থ করেন, তখন একটি বাজারকেই মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। নাটক নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা খুবই সফল হয়েছিল এবং সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিল।
অভিনয় যে কতো সাবলীল আর প্রাণবন্ত হতে পারে দিল্লির নয়া থিয়েটার দলের অভিনয়ে তারই পরিচয় পেয়েছিলাম। নাগরিক আয়োজিত নাট্যোৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল কলকাতার ‘বহুরূপী’ ও দিল্লির ‘নয়া থিয়েটার’ দল। আমার সুযোগ হয়েছিল নয়া থিয়েটারের আগ্রাবাজার ও চরণদাস চোর নাটক দেখার।
কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ আর অন্যান্য সাময়িকীর মাধ্যমে হাবিব তানভীর আর তার চরণদাস চোর নাটকের সুখ্যাতির কথা জানা ছিল। তাই হাবিব তানভীর ঢাকায় আসছেন ও চরণদাস চোর অভিনীত হবে জেনে মনে মনে কৌতূহলী হয়েছিলাম।
আগ্রাবাজার আর চরণদাস চোর দেখে কোথাও মনে হয়নি যে অভিনয় দেখছি। পুরো দৃশ্যকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন নাটকের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।
লোক কাহিনীভিত্তিক নাটক হাবিব তানভীরের ‘চরণদাস চোর’ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে। শঠতা ও ছলনা, ‘হিপোক্র্যাসি’ যখন আজকের সমাজ ও পৃথিবীকে গ্রাস করতে বসেছে তখন চরণদাস চোর তার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। চরণদাস চোর যেন হিপোক্র্যাসির গালে এক থাপ্পড়।
চরণদাস চোর লোক কাহিনীভিত্তিক হলেও এর সামাজিক তাৎপর্য আজো অক্ষুণœ। ১৯৮২ সালে এডিনবরা আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে চরণদাস চোর প্রথম অভিনীত হয়ে সর্বোচ্চ মানের ফ্রিঞ্জ পুরস্কার লাভ করে এবং বৃটিশ নাট্যসমালোচক ও নাট্যরসিকদের প্রশংসা অর্জন করে। ইউরোপের নানা দেশে একইভাবে বিপুল প্রশংসিত হয়েছে এ নাটক। ভারতের নাট্য-আন্দোলনের জগতের কিংবদন্তিসম পুরুষ হাবিব তানভীর নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষের কথা ও জীবনের কথা বলেন। নাটক তার কাছে দারিদ্র্য-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। তবে হাবিব বলেন, থিয়েটারের কাজ সমাজ বদল করা নয়, তার কাজ সমাজের সমস্যাকে চিহ্নিত করা। থিয়েটার সমস্যার সমাধান দেবে না। সমাধান দেবে জনগণ। থিয়েটার কর্মীদের কাজ হলো সমাজ বদলের প্রয়োজন সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। তবে সমাজ বদলের কাজ করবে রাজনৈতিক কর্মীরা।
হাবিব তানভীর ১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ছত্তিশগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। হাবিব বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের যুগে আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত হন। পরে হাবিব তানভীর ১৯৫৪ সালে দিল্লির প্রথম পেশাদারি নাট্যগোষ্ঠী হিন্দুস্তানি থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন বেগম কুদসিয়া জায়েদির সঙ্গে একযোগে। ১৯৫৫ সালে বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে যান এবং রয়াল একাডেমি অফ ড্রামাটিক আর্টসে (রাডা) পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সালে ফিরে এসে আবার কাজ শুরু করেন। নিজ এলাকা উত্তর ভারতের ছত্তিশগড়ের শিল্পীদের সঙ্গীত ও নৃত্যে আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাদের নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং তাদের মঞ্চে নিয়ে আসতে উদ্যোগী হন। এ নিয়ে কুদসিয়া জায়েদির সঙ্গে মতবিরোধ হলে তিনি হিন্দুস্তানি থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে ১৯৫৯ সালে ‘নয়া থিয়েটার কোম্পানি’ গঠন করেন। ছত্তিশগড়ের দেহাতি লোকশিল্পীদের তিনি মঞ্চে নিয়ে এসেছেন, তাদের স্বাভাবিক শিল্পপ্রতিভাকে আরো বিকশিত করতে সাহায্য করেছেন। কিন্তু তাদের গা থেকে মাটির গন্ধ মুছে ফেলেননি, তাদের সাবলীলতা নষ্ট হতে দেননি। এই শিল্পীদের নিয়ে তিনি পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে গেছেন, সফর করেছেন বৃটেন, ফ্রান্সসহ বহু দেশ।
হাবিব তানভীরের নাটকে মঞ্চের মায়াভঙ্গের বিষয়টিও উপেক্ষিত ছিল না। মঞ্চে একদিকে বিশেষভাবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে লোকশিল্পীদের অভিনয় নৈপুণ্যকে; যাদের বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে কলাকাররূপে। আমাদের প্রথাকেন্দ্রিক নাট্য ধারণায় এদের স্বাভাবিক ও সাবলীল অভিনয় দেখে আমার কেবলই মনে হয়েছে, যোগ্য মানুষের হাত থেকে কতো সাধারণ বিষয় ও অনুষঙ্গই কতো অসাধারণ হয়ে উঠতে পারে।
হাবিব এক বক্তৃতায় বলেন তার বিশ্বাসের কথা, ‘জনগণই সংস্কৃতির প্রকৃত স্রষ্টা। বিরুদ্ধ স্রোতের বিপরীতে মানুষের সংগ্রামের মধ্যেই সংস্কৃতির জন্ম। জীবনের মধ্য থেকেই উৎসাহিত হয় শিল্প ও সংস্কৃতি, তার নানা ফর্ম আর তাকে মোটেই কম গুরুত্ব দেয়া যায় না।’ তাই এ দিকটাকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেন হাবিব। ঢাকায় সেবার নিমকোতে হাবিবের বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। সেও এক বিরল সৌভাগ্য।
হাবিব বলেন, ‘কলম দিয়ে নয়, বরং আমার লোকশিল্পীদের নিয়ে আমি কাহিনী লিখেছি যাদের প্রত্যেকেই গল্পে গল্পে গেঁথে তুলেছে কাহিনী। পরিচালনার ক্ষেত্রেও একই কায়দা অনুসৃত হয়েছে।’ হাবিবের এই নাট্য ধারণা, জীবনের নিজস্ব ধারায় বেড়ে ওঠা জীবন উৎসারিত এই শিল্পচর্চার ধারণাটি একদিনে গড়ে ওঠেনি। সামাজিক অঙ্গীকারের ভেতরেও আছে আরেক মাত্রা, অধ্যয়ন ও নিরীক্ষার ভেতর থেকে তিনি এ অর্জন করেছিলেন। হাবিব এ সম্পর্কে বলেন, ‘বস্তুত দীর্ঘদিন থেকে একাগ্রতার সঙ্গে এই টেকনিকের সিদ্ধি অর্জনে ব্রতী রয়েছি গ্রামীণ শিল্পীদের সহায়তায়Ñ যারা গঠন করেছেন নয়া থিয়েটারের পেশাদারি ভিত্তিমূল।’ থিয়েটারই হাবিব তানভীরের জীবন। তার সহশিল্পীরা সম্পূর্ণ পেশাদার। তারা বেতনভাতা পেয়ে থাকেন, ছুটির সময় তারা গ্রামে ধান কাটতে চলে যান।
ঢাকায় উৎসবের শেষদিনের অনুষ্ঠান শেষে তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা তাকে অভিভূত করেছে। তিনি বলেন, উপমহাদেশের এই দুটি দেশের মধ্যে যেমন রয়েছে সাংস্কৃতিক মিল তেমনি আরেকটি ক্ষেত্রে মিল রয়েছে যা দুটি দেশকে এক বন্ধনে গ্রন্থিত করেছে তা হলো দারিদ্র্য। দুটি দেশের মানুষই আমরা দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য লড়ছি। আগের দিন সন্ধ্যায় আমার সুযোগ হয়েছিল এক নৈশ আহারে তার সঙ্গে আলাপ ও পরিচয়ের এবং পুরো দলটিকে কাছে থেকে দেখার। তিনি নিজে প্রথমে তার শিল্পীদের বসানোর ব্যবস্থা সুশৃঙ্খলভাবে করলেন, সবটা করে এসে তবেই তিনি নিজের জায়গায় এসে বসলেন। মনে মনে হাবিব তানভীরের প্রতি প্রণত হয়ে ভেবেছি, মানুষের প্রতি কতোটা মর্যাদা এবং শিল্পের প্রতি কতোটা মর্যাদা ও কতোটা মমত্ব থাকলে সাধারণ মানুষের, সাধারণ লোকশিল্পীদের একটি গ্রুপকে দিয়ে কী অনন্যসাধারণ কাজই তিনি করিয়ে নিতে পারেন।
আলোচিত এ দুটি নাটক ছাড়াও তিনি বহু নাটক সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য জিস লাহোর নেহি দেখা, পঙ্গা প-িত, রাজরক্ত, কাম দেবকা আপনা বসন্ত ঋতুকা স্বপ্না ইত্যাদি। রুদ্রপ্রশাদ সেনগুপ্ত যেভাবে বলেছেন, এখানেই হাবিবের মেজাজ। বাইরের জানালা-দরজা খোলা, পা দেশজ সংস্কৃতিতে গাঁথা। এই মন ছিল বলেই তিনি শেক্সপিয়রের মিড সামার নাইটস ড্রিম অবলম্বনে কামদেব কা আপনা বসন্ত ঋতু কা স্বপ্না নামাতে পেরেছেন। সেখানে শেক্সপিয়রের যাবতীয় তির্যক দুষ্টুমি রয়েছে আবার ছত্তিশগড়ের দেহাতি জীবনও যাবতীয় সংবেদনশীলতা নিয়ে উঠে এসেছে।
শম্ভুমিত্র চরণদাস চোর বারবার দেখতে আসতেন। বলতেন, ‘হাবিব জানে না, ও কী করেছে’।
শেক্সপিয়র, ব্রেখটের অন্দরে ছত্তিশগড়ি নাচ, লোককথার অনায়াস যাতায়াত। আলোচিত নাটকগুলো ছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য অন্য নাটকের মধ্যে রয়েছে পঙ্গা প-িত, রাজরক্ত। নব্বইয়ের দশকে ধর্মীয় ভ-ামির বিরুদ্ধে তার পঙ্গা প-িত উগ্র হিন্দুদের খুবই ক্ষুব্ধ করেছিল। সব বাধা উপেক্ষা করে সারা ভারতে তিনি নাটকটি সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চায়ন করেন।
জীবনের শেষ পর্যায়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিসর্জন নাটক ও রাজর্ষি উপন্যাস অবলম্বনে তিনি রাজরক্ত নাটকটি লেখেন ও পরিচালনা করেন।
হাবিব রিচার্ড অ্যাটেনবরোর গান্ধীসহ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
হাবিব তার থিয়েটারে নিবেদিত জীবনে বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। হাবিব তানভীর ‘পদ্মশ্রী’, সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার, খয়ড়াগড় সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি লিট উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। ১৯৭২ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য।
এছাড়াও হাবিব তানভীর ১৯৮৩ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমী অ্যাওয়ার্ড, ১৯৮৩ সালে পদ্মশ্রী, ১৯৯০ সালে কালীদাস সম্মান, ১৯৯৬ সালে সঙ্গীত নাটক একাডেমী ফেলোশিপ এবং ২০০২ সালে পদ্মভূষণে সম্মানিত হয়েছেন। আর পেয়েছেন অগণিত দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসা।
মহান নাট্যস্রষ্টা হাবিব তানভীরকে জানাই শ্রদ্ধা ও প্রণতি।
মন্তব্য করুন