বিশ্বের জনসংখ্যার ৮-১০ ভাগ দম্পতি কোন না কোন রকমের বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভুগছে। এর চিকিৎসা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে করতে হবে। তাই প্রতিটি দম্পতির উচিত হতাশায় না ভুগে, দু’জনে একসঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া
অধ্যাপক ডা. ফিরোজা বেগম
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
সন্তান লাভের আশায় কোন দম্পতি কোন প্রকার গর্ভনিরোধক উপায় অবলম্বন না করে এক বছর স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনযাপনের পরও যদি স্ত্রীর গর্ভসঞ্চার না হয় তখন তাকে বন্ধ্যত্ব বলা হয়। দেখা গেছে ৬ মাসে একমাস সহবাসের পর শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে এবং এক বছর পর শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে মহিলারা গর্ভধারণ করে থাকেন। স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করার এক বছরের মধ্যে সন্তান সম্ভাবনা না ঘটলে স্বামী বা স্ত্রী অথবা উভয়েরই ত্র“টি থাকতে পারে। বন্ধ্যত্বের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্ত্রী, ৩৫-৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে স্বামী এবং ১০-২০ শতাংশ ক্ষেত্রে উভয়ের ত্র“টির জন্য গর্ভধারণ হয় না। বাকি ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে বন্ধ্যত্বের কোন সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।
পুরুষদের বন্ধ্যত্বের কারণ ষ
বীর্যে উপযুক্ত পরিমাণে গতিশীল শুক্রাণুর (স্পার্ম) অভাব প্রধান কারণ। পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়Ñ
শুক্রাণুর উৎপাদন সমস্যা, যা হতে পারে গুণগত বা সংখ্যাগত।
মানসম্পন্ন শুক্রাণু নিঃসরণে অক্ষমতা এবং
ইমিউনোলজিক্যাল সমস্যা
কিছু কিছু ক্ষেত্রে জš§গত ত্র“টি যেমন- শুক্রাশয় (ঞবংঃবং) শুক্রথলিতে (ঝবৎড়ঃঁস) না থাকলে বন্ধ্যত্ব হতে পারে। শুক্রাণু তৈরির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ এবং তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়, শুক্রথলিতে এই তাপমাত্রা বজায় থাকে। জš§গত কারণে শুক্রাশয়, শুক্রথলিতে না থাকলে শুক্রাণু তৈরির সঠিক তাপমাত্রা বজায় থাকে না এবং শুক্রাণু তৈরি প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।
পুরুষদের বন্ধ্যত্বের আরেকটি অন্যতম কারণ হল ইনফেকশন। মাম্পস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গনোরিয়া, যক্ষ্মা (ঞঁনবৎপঁষড়ংরং) ইত্যাদি পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে।
এছাড়া অতিরিক্ত গরম পরিবেশে কাজ করা, গরম পানিতে গোসল করা অথবা নাইলনের তৈরি অন্তর্বাসের ব্যবহার শুক্রাণু তৈরি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে, কারণ শুক্রাণু তৈরির উপযুক্ত তাপমাত্রা এতে বজায় থাকে না।
অতিরিক্ত ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, মাদকদ্রব্য যেমন কোকেইন সেবন, কোনও কোনও ব্লাড প্রেসারের ওষুধ যেমন নিফিডিপিন শুক্রাণুর ডিম্বাণু নিষিক্তকরণ ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয় এবং বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুক্রথলির অপারেশন যেমন হার্নিয়া, হাইড্রোসিল অপারেশন, শুক্রথলিতে আঘাত লাগা, এক্সরে ইত্যাদি পুরুষের বন্ধ্যত্বের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
হরমোনজনিত সমস্যা এবং জেনেটিক সমস্যাও বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে।
মহিলাদের বন্ধ্যত্বের কারণ
ডিম্বাশয়ে ডিম্বাণু তৈরির জটিলতা মেয়েদের বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। দেখা গেছে ২০-২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে এই সমস্যা মেয়েদের বন্ধ্যত্বের জন্য দায়ী।
থাইরয়েড গ্রন্থির অসুখ, পলিসিস্টিক ওভারি বা ওভারির সিস্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে।
মেয়েদের প্রজননতন্ত্রের জš§গত, গঠনগত ত্র“টি, ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাধা, এন্ড্রোমেট্রিওসিস, অধিক পরিমাণে প্রল্যাকটিন হরমোন তৈরি, জরায়ুর ইনফেকশন, জরায়ুর টিউমার অনুর্বরতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
শুধুমাত্র স্বামী বা স্ত্রীর প্রজনন অঙ্গের নানা ত্র“টি বা অসুখ নয় আরও নানা বিষয় আছে যার কারণে বন্ধ্যত্ব হতে পারে।
যেমন বয়স যা পুরুষের চেয়ে মেয়েদের ক্ষেত্রে অধিক প্রযোজ্য। মেয়েদের বেলায় ২৫-৩০ বছর বয়স সন্তান জš§দানের উপযুক্ত সময়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ্যত্বের সমস্যাগুলো জটিল হয়। যত বয়স বাড়তে থাকে ডিম্বাণুর সংখ্যা তত কমতে থাকে। এই ডিম্বাণু হ্রাসের প্রক্রিয়া শুরু হয় ত্রিশ বছর বয়স থেকে এবং ডিম্বাণু হ্রাসের প্রক্রিয়া দ্রুত হয় চল্লিশের কাছাকাছি বয়সে। বয়সের সঙ্গে ডিম্বাণুর কোয়ালিটি নষ্ট হতে থাকে, সেই সঙ্গে দেখা দেয় জেনেটিক নানা ত্র“টি। কাজেই বিবাহিত মহিলাদের বয়স ৩৫-এর কাছাকাছি এলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করানো উচিত।
বয়স ছাড়াও স্বামী বা স্ত্রীর শরীর অস্বাভাবিক মোটা হলে, মানসিক কারণে শারীরিক মিলনে লজ্জা বা ভয় বন্ধ্যত্বের কারণ হতে পারে।
বৈবাহিক জীবনে অশান্তি বা দ্বন্দ্বের জন্য শারীরিক সম্পর্ক অনিয়মিত বা সময়মতো না হলে গর্ভসঞ্চার নাও হতে পারে।
অনেক সময় স্বামী ও স্ত্রী ভিন্ন জায়গায় থাকেন, কাজেই যখন গর্ভধারণের সময় সেই সময়ে এক সঙ্গে থাকা হয় না। এটাও বন্ধ্যত্বের একটা কারণ হতে পারে। প্রতিটি নিঃসন্তান দম্পতির মনে রাখা উচিত বন্ধ্যত্বের সমস্যা যে কোনও একজনের অথবা উভয়েরই হতে পারে। বন্ধ্যত্বের সঠিক কারণটি নানারকম আধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অনুসন্ধান করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায়।
ইনফার্টিলিটিতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা
পুরুষের ক্ষেত্রে সিমেন (বীর্য) পরীক্ষা অত্যন্ত জরুরি। সিমেন পরীক্ষার রিপোর্ট যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে স্বামীর উল্লেখযোগ্য কোনও সমস্যা নেই বলা যেতে পারে। মূলত সিমেনে উপযুক্ত পরিমাণে গতিশীল স্পার্মের অভাবই বন্ধ্যত্বের প্রধান কারণ। একজন সুস্থ স্বাভাবিক পুরুষের বীর্যে সময়ের সঙ্গে শুক্রাণুর সংখ্যা ও গতিশীলতার তারতম্য হতে পারে। যদি সিমেন পরীক্ষায় ইনফেকশনের লক্ষণ থাকে তাহলে এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা দরকার হয়। এছাড়া ধূমপান, অ্যালকোহল হতে বিরত থাকা, ওজন কমানো, ডায়াবেটিস এবং হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণ রাখা ইত্যাদি সন্তান উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সর্বোপরি সুস্থ জীবনযাপন বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
চিকিৎসা
বীর্যে শুক্রাণুর সংখ্যা কম থাকলে ওটও একটি উপযুক্ত পদ্ধতি। এই পদ্ধতি ডিম্বাণু নিঃসরণের সময়ে জরায়ুর ভেতরে স্বামীর বীর্য (ঝবসবহ) বিশেষভাবে প্রসেসিংয়ের পর সূক্ষ্ম ক্যাথেটারের মাধ্যমে দিয়ে দেয়া হয়।
তবে শুক্রাণুর সংখ্যা ৫ মিলিয়নের নিচে বা শুক্রাণুর গঠনগত ত্র“টি থাকলে বা নড়াচড়া কম থাকলে ইকসি (ওঈঝও) দরকার হয়। ইকসি পদ্ধতিতে একটি ডিম্বাণুর মধ্যে একটি সুস্থ শুক্রাণু ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে ডিম্বাণু নিষিক্ত করা হয়। যেসব পুরুষের ক্ষেত্রে বীর্যবাহী নালীতে বাধা থাকে তাদের বেলায় সার্জিক্যাল পদ্ধতির মাধ্যমে (গঊঝঅ, ঞঊঝঅ, চঊঝঅ-এর মাধ্যমে) শুক্রাণু সংগ্রহ করে ইকসি করা যায়। পুরুষের বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে ইকসি অত্যন্ত উন্নত ধরনের চিকিৎসা এবং এই চিকিৎসা ব্যবস্থা সব সেন্টারে থাকে না।
পুরুষের ক্ষেত্রে যেমন সিমেন পরীক্ষা জরুরি, তেমনি মেয়েদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন হরমোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের জটিলতা এবং প্রতি মাসে ডিম্বাশয় হতে ডিম্বাণু নিঃসরণ হচ্ছে কি না তা নির্ণয় করা হয়। যদি স্বামীর বীর্যের মান ঠিক থাকে এবং স্ত্রীর ডিম্বাশয়ে কোনও সমস্যা না থাকে তবে পরবর্তী ধাপ হচ্ছে ফেলোপিয়ান টিউবে (ডিম্বনালী) কোনও বাধা আছে কি না তা যাচাই করে দেখা। টিউবের সমস্যা আছে কিনা তা দেখার সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হল ল্যাপারস্কপি। ল্যাপারস্কপির মাধ্যমে টিউব দেখা ছাড়াও জরায়ু বা ডিম্বাশয়ের অন্য কোনও সমস্যা আছে কি না তা দেখা যায় যেমনÑ জরায়ুর টিউমার, ডিম্বাশয়ে সিস্ট, এন্ডোমেট্রিওসিস, পেলভিক ইনফেকশন ইত্যাদি।
টিউবে ব্লক থাকলে টেস্ট টিউব (ওঠঋ) পদ্ধতিতে বাচ্চা নেয়া যায়। এই পদ্ধতিতে প্রথমে হরমোন জাতীয় ওষুধ দিয়ে ডিম্বাশয়কে নিষ্ক্রিয় করা হয়। আল্ট্রাসনোগ্রাম ও হরমোন পরীক্ষার মাধ্যমে যখন দেখা যায় যে ডিম্বাশয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে তখন আবার অন্য ধরনের হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে ডিম্বাশয়কে সক্রিয় করা হয়। এর পর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু সংগ্রহ করে, স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে ভ্রƒণ তৈরি করা হয় এবং প্রাপ্ত ভ্রƒণ জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়।
চিকিৎসায় সফলতা
ওটও-এর ক্ষেত্রে প্রতি মাসে সন্তান ধারণের হার ১০-১৫ ভাগ। বিগত দশ বছরে ওঠঋ-এর সফলতার হার ধীরে ধীরে বেড়েছে। বিশ্বের উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও এই হার ৩০-৪০ শতাংশের মতো, যা ওঈঝও-র ক্ষেত্রে ৪০-৫০ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে। এই সফলতার হার এক সেন্টার থেকে অন্য সেন্টারে আলাদা। কারণ তা সেন্টারের মান, চিকিৎসকের দক্ষতা এবং রোগীর ধরনের ওপর নির্ভরশীল।
বন্ধ্যত্ব মানেই ওটও, ওঈঝও কিংবা ওঠঋ পদ্ধতি নয়। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা নির্ভর করে বন্ধ্যত্বের কারণের ওপর। অনেক দম্পতির ক্ষেত্রে জটিল চিকিৎসা পদ্ধতির কোনও প্রয়োজনই পড়ে না। ডিম্বাশয়ের অনুর্বরতা ক্লোমিফেন সাইট্রেট কিংবা লেট্রোজল জাতীয় ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে গর্ভসঞ্চারণ করানো সম্ভব হয়। বন্ধ্যত্ব নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কুসংস্কার আছে। বন্ধ্যত্বের চিকিৎসায় বয়সের যেহেতু একটা বিরাট ভূমিকা আছে তাই তাড়াতাড়ি এই চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা নিতে গিয়ে অনেক দম্পতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন, নতুন চিকিৎসকের কাছে আগের চিকিৎসকের কথা গোপন করেন এবং দেখা যায় একই ডিম্ব নিঃসারক ওষুধ ভিন্ন নামে মাসের পর মাস খেতে থাকেন। ডিম নিঃসারক ওষুধ অনেকদিন ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন ডিম্বাশয়ের ডিম্বাণুর সংখ্যা কমে যায় অন্যদিকে পরবর্তী জীবনে ডিম্বাশয়ে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
মন্তব্য করুন