জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া লাভ কি? পৃথিবীতে কে কাহার…

আনিসুল হক
আমাদের নেতারা সব সময়ই নিজেদের মনে করেন জনতার কন্ঠস্বর, কখনো কখনো নিজেকে তাঁরা জাতির মুখপাত্র বলেই দাবি করে থাকেন। হরতালের পরের দিন হরতাল পালন করার জন্য জাতিকে অভিনন্দন জানানো হয় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে, আবার সরকারি দলের পক্ষ থেকে জনগণকে ধন্যবাদ জানানো হয় হরতালে সাড়া না দেওয়ার জন্য। উভয় ক্ষেত্রে জনতা নামের বায়বীয় পদার্থটির নিজের কিছু বলার আছে কি না কেউ ধার ধারে না। আবার বাজেট পেশ করার পর জাতি এই বাজেট প্রত্যাখ্যান করেছে বলে দাবি করা হয় বিরোধী দলের পক্ষ থেকে, একইভাবে সরকারি সাংসদেরা জাতির পক্ষ থেকে এমন একটা যুগান্তকারী বাজেটের জন্য অর্থমন্ত্রীকে আর অর্থমন্ত্রীকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানান। জাতি বলতে তাঁরা তাঁর নিজ পরিবার আর খালাত-ফুপাত ভাইবোনের সমাবেশ বুঝে থাকেন কি না জানি না।
তবে নিজেকে যখন জাতির কন্ঠস্বর হিসেবে তাঁরা উপস্থাপন করেন, কেউ তার কোনো প্রতিবাদও করে না। কে করবে? জাতির নিজের তো আর কোনো পাবলিক রিলেশন অফিসার থাকে না।
কিন্তু তাই বলে জনতা কিছু বোঝে না, সাত চড়েও রা করে না, তাদের করার কিছু নেই, এটা ভাবাটা হবে চরম বোকামি। বাংলাদেশের মানুষ সব বোঝে, সবই দেখে আর বিচার করে, যখন তাদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার থাকে, তখন তারা সেটা ঠিক ঠিকভাবে ব্যক্ত করে, যখন প্রয়োজন হয় তাদের গা-ঝাড়া দেওয়ার, তখন তারা সেটা ঠিকই দেয়, আর যখন দরকার পড়ে তারা ভীষণভাবে গর্জে ওঠে, ফুসে ওঠে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারা কী করছেন, কী বলছেন, সরকারই বা কী করছে, কী করছে না, জনগণ সবই দেখছে আর বিচার করছে। সেসবের হিসাবও তারা তুলে রাখছে খেরোখাতায়। যখন সিদ্ধান্ত দেওয়ার, তারা ঠিকই দেবে। যখন দরকার বদলে দেওয়ার, তারা সেই প্রক্রিয়ায় পালন করবে নিয়ামকের ভুমিকা।
বর্তমান সরকার সেনা ও গণমাধ্যম-সমর্থিত বটে। কিন্তু এই সরকার যে এসেছে, তারা যে ভুমিকা পালন করছে, বহু রথী-মহারথীকে জেলে পুরেছে, সবই সম্ভব হয়েছে একটাই কারণে, জনগণের সমর্থন। আর জনগণকে কেন এই সরকারকে এভাবে, নীরবে হলেও সমর্থন দিয়ে গেছে? কারণ, তারা রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
রাজনৈতিক পক্ষ এই দেশে দুটো, বিএনপি আর আওয়ামী লীগ। আর তাদের প্রতি জনগণের সমর্থনও আছে, কিন্তু জনগণ চায়, অতীতের ভুলগুলো থেকে তাদের নেতারা শিক্ষা নিক। পুরোনো সেই রাজনীতির অপবৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে আসুক।
এ কথাটাই বা আমরা বলছি কী করে? এমপিরা তো তবু জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, কিন্তু কলামলেখক কিংবা টকশোর আলোচক তো তাও নন। জনগণ কী চায় তাঁরা কীভাবে বলেন। দুইভাবে বলা যায়। যে লেখক বা আলোচক কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ হয়ে যাননি, তিনি সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার খোঁজ পেতে পারেন। আর তাঁর নিজের বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে সেটারও একটা প্রভাব উল্টো জনমতের ওপর পড়তে পারে, জনমত গঠনে তাঁরা ভুমিকা রাখতে পারেন।
সেই সুত্র ধরেই বলতে পারি, দেশের মানুষ এখন নির্বাচন চায়। মানুষ নির্বাচন চায়, কিন্তু যখনই মনে হয়, আবার সেই লাল্টু-পিন্টু-হাজারির যুগে ফিরে যেতে হবে কি না, তখনই বুকটা কেঁপে ওঠে।
মানুষ নির্বাচন চায়, এই বার্তাটা রাজনৈতিক দলগুলোও নিশ্চয়ই বোঝে। এটা খুবই ইতিবাচক যে রাজনৈতিক দলগুলো নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে শুরু করেছে। রাজনীতি করব, দেশ শাসন করতে চাইব, জনগণকে বলব আইন মেনে চলতে, আর নিজেরা কোনো আইন-কানুন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার ধার ধারব না, এটা হয় না। আমরা অবশ্যই চাইব রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের কাজকর্ম পরিচালিত হোক স্বচ্ছভাবে। তারা কোত্থেকে টাকা পায়, কীভাবে খরচ করে, এটা অবশ্যই জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে।
আর নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এখন সবাই মিলে একটা সুন্দর, সুষ্ঠু, জনরায়ের প্রকৃত প্রতিফলনের নির্বাচনের চেষ্টাই করে যেতে হবে। বর্তমানে গণতন্ত্রই দেশশাসনে শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে দেশে দেশে বিবেচিত ও নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। গণতন্ত্র বলতে শুধু যে নির্বাচন বোঝায় না, সেটাও ঠিক। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। জনগণের মালিকানা বা অংশীদারি প্রতিষ্ঠিত করতে অবশ্যই জনপ্রতিনিধিদের দিয়েই দেশ পরিচালিত হতে হবে।
আর নির্বাচন ঠিক সময়ে হবে না, এই অলক্ষুণে কথাতে হাওয়া দেওয়া আমাদের উচিত হবে না। নির্বাচন না হলে কী হবে আমরা জানি না। নির্বাচনে কোনো একটি পক্ষ যদি অংশ না নেয়, তাহলেও সেটা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে না। বিগত প্রায় দুই বছর আমরা এই দেশে কোনো হরতাল দেখি না। না দেখতে দেখতে হরতাল না দেখা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। নির্বাচনে একদল জিতবে, আরেক দল হারবে। যে পক্ষ হারবে, তারা দু-একদিনে শোক পালন শেষে সরকারকে অস্িথতিশীল করতে আদাজল খেয়ে লেগে পড়বে, এই প্রথার অবসান তো হতে হবে। এখানে আসে দেশের স্বার্থ, মানুষের স্বার্থ, জাতির স্বার্থ।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারাই আমাদের জনগণের মুখপাত্র, সেটা আমরা মেনে নিতে প্রস্তুত। তার সঙ্গে এটাও প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই যে শুধু নিজেদের ক্ষমতায় নেওয়ার হিসাব-নিকাশ নয়, আমাদের নেতারা মানুষের কিসে ভালো হবে, সেই হিসাবটাও করছেন।
হ্যাঁ, ভোটে দুই পক্ষ একই সঙ্গে জিততে পারবে না। কিন্তু আমরা চাই দুই পক্ষই নির্বাচনে অংশ নিক। আর জনগণের রায় হাসিমুখে মেনে নিক। নতুন সরকারও বিরোধী দলকে শান্তিতে-স্বস্তিতে থাকার সুযোগ করে দিক। গণতন্ত্র মানে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়, একটা বিরোধী মত যদি একাকী নিঃসঙ্গও হয়, সেটাকেও প্রকাশ করতে দেওয়া, সেই মত ও মতাবলম্বীকে শ্রদ্ধা করা, গণ্য করা। আর আমরা এত দিন প্রায় সমান ভোট কখনো কখনো সরকারি দলের চেয়ে বেশি ভোট পাওয়া বিরোধী দলকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের নির্মম অভিযানে মত্ত হতে দেখেছি সরকারি দলকে। এই গতানুগতিক আচরণের পরিবর্তনও চাই এবার।
আসলে চাই মানুষকে, দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবেশ। ডিসেম্বরে নির্বাচন হোক, নতুন বছরে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসুক। বিরোধী দলকে সঙ্গে নিয়ে তারা দেশে শুরু করুক এগিয়ে যাওয়ার কর্মযজ্ঞ।
গণতন্ত্রে মানুষের বিকাশের নানা পথ খুলে যায়। তার সৃষ্টিশীলতা প্রাণ পায়। নির্বাচিত সরকারের করারও থাকে অনেক কিছু। জনসমর্থন থাকায় তারা অনেক কঠিন সিদ্ধান্তও সহজে নিতে পারে। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন থাকলে কয়েকজন উগ্রপন্থীর দাবির মুখে অর্ধকোটি টাকা খরচ করে ফেলার পরে বিমানবন্দর মোড়ের ভাস্কর্যটি সরিয়ে ফেলতে হতো না। যেহেতু এই সরকার নির্বাচিত নয়, আর তার সামনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনই প্রধান কাজ, সেহেতু তারা হয়তো যেকোনো ধরনের সংঘাত এড়িয়ে যেতে চাইছে।
বাংলাদেশকে উন্নয়নের আলোকিত ধারায় নিয়ে যেতে হবে। সর্বত্র কাজের আর এগিয়ে যাওয়ার একটা অনুপ্রেরণাময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সেটা সম্ভব গণতান্ত্রিক আবহে। কিন্তু সেই গণতন্ত্র মানে নির্বাচিতদের স্বৈরতন্ত্র নয়। সেই গণতন্ত্র মানে লুটতরাজ-দখল-চাঁদাবাজি নয়। সেই গণতন্ত্র মানে কথায় হরতাল-অবরোধ নয়। আমরা তো অনেক সময় নষ্ট করে ফেলেছি। ১৯৪৯ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পূর্ববঙ্গের মানুষের মাথাপিছু আয় চীন, কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুরের চেয়ে অনেক বেশি। মালয়েশিয়া তো সেদিনও ছিল অনুন্নত। আমাদের চোখের সামনে সবাই উন্নতির দৌড়ে এগিয়ে গেল, দেশের ভাগ্যবদল ঘটাল, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করল। আজকে একটু কাজের খোঁজে কোরিয়া বা মালয়েশিয়ায় যেতে পারাটাই আমাদের বহু যুবকের জন্য চরম মোক্ষ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
দেশটাকে অবশ্যই এগিয়ে নিতে হবে। তার নেতৃত্ব দিতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকে। সারা পৃথিবীতেই রাজনীতি করেন রাজনীতিকেরা, পেশাজীবী বিশেষজ্ঞরা তাঁদের নেতৃত্বাধীন থেকে দেশের উন্নতিতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। বুশ বা ক্লিনটন সাহেবের চেয়ে যুদ্ধ বেশি বুঝবেন সমরবিশেষজ্ঞরা, অর্থনীতি বেশি বুঝবেন অর্থনীতিবিদেরা, তবু দেশ কিন্তু পরিচালনা করবেন বুশ সাহেবরা, এমনকি যুদ্ধ পরিচালনার সময়ও সমরবিদেরা মেনে চলবেন বুশ সাহেবদের নির্দেশ, তা যদি ভুলও হয়, তবুও।
আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু রাজনীতি কেন, বুকে হাত দিয়ে এ প্রশ্নটার মুখোমুখি একবার হতে হবে। রাজনীতি কি সবার ওপর ছড়ি ঘোরানোর জন্য, নিজের ভাগ্য বদলের জন্য? নাকি দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য?
আমরা সব সময়ই আমাদের নেতাকে মনে করিয়ে দেব যে ভুল করার কোনো অবকাশ আর নেই। আমাদের অবশ্যই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজদলীয় স্বার্থের পাশাপাশি দেশ ও জনগণের স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিতে হবে।
যেহেতু নির্বাচন ঠিক সময়ে না হলে কী হবে আমরা জানি না, সেই অনিশ্চয়তার চোরাবালিতে কেন আমরা দেশকে ঠেলে দেব? রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়া। এর আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করেছে। এখনো নির্বাচনের জন্য দুই মাস সময় বাকি আছে। অবশ্যই নির্বাচন সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা সে ক্ষেত্রে খুবই জরুরি। যে জনগণের দোহাই তারা সব সময়ই পাড়ে, তাদের কথা ভেবে এ মুহুর্তে তাদের কর্তব্য হলো নির্বাচনী কর্মকান্ডে পূর্ণোদ্যমে যুক্ত হয়ে পড়া। ১৯৭০-এর প্রলয়ঙ্করী ঘুর্ণিঝড়ের অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই দেশের মানুষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলে দলে ভোট দিয়েছিল। যথেষ্ট সময় আছে, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়লেই নির্বাচন ঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। আমরা কায়মনোবাক্যে সেটাই প্রত্যাশা করি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান